- বইয়ের নামঃ একাত্তর এবং আমার বাবা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময়
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই, ইতিহাস, জীবনী
ভূমিকা : একাত্তর এবং আমার বাবা
প্রায় হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদের এই পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হয়েছে। সে যখন এটি লিখেছিল তখনো সে হুমায়ূন আহমেদ হয়নি। ঠিক কখন এটি লিখেছে কেউ সেটি ভালো করে বলতে পারে না। অনুমান করা হয় একাত্তরেই সে এটি লিখেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে মারা যাওয়া আমার বাবার মৃত্যুর ঘটনাটিই ছিল মূল বিষয়—তার কারণ সে ঠিক যে-জায়গায় শেষ করেছে তার পরের অংশটুকু আমার লেখা। হুমায়ূন আহমেদ সম্ভবত প্রথম অংশটুকু শেষ করে বাকিটুকু আমাকে লিখতে বলেছে, কারণ শেষ দিনটিতে আমি আমার বাবার সাথে ছিলাম; তাই শুধু আমিই সেটি লিখতে পারব। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল তাই আমি কিছুতেই মনে করতে পারিনি কখন এটি লিখেছি। আমার ভাইবোন বা মাও সেটি মনে করতে পারেনি কাজেই সঠিক সময়টি বলা যাচ্ছে না, অনুমান করছি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লেখা হয়েছিল।
এটি প্রায় ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো, কাজই এটাকে বই হিসেবে প্রকাশ করা উচিত হবে কি না সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরে আমার লেখা অংশটুকু জুড়ে দেওয়া হবে কি না সেটা নিয়ে আমার মা, ভাই, বোন সবার সাথে আলোচনা হয়েছে। আমি নিজের অংশটুকু জুড়ে দিতে খুবই অনিচ্ছুক ছিলাম কিন্তু আমাদের পরিবারের সবাই পুরো লেখাটুকু পূর্ণাঙ্গ করার জন্যে শেষ অংশটুকু যুক্ত করে দেয়া উচিত বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাই এই প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখার সাথে আমার লেখা জায়গা করে নিয়েছে।
আমি জানতাম হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় লেখক। লেখকদের বেলায় শব্দটা জনপ্রিয় না হয়ে পাঠকপ্রিয় হওয়ার কথা, যারা পাঠক শুধু তারাই লেখকের ভক্ত হতে পারে অন্যদের তো আর সেই সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে হুমায়ূন আহমেদ শুধু পাঠকপ্রিয় ছিল না, সে অসম্ভব জনপ্রিয় মানুষ ছিল। কেমন করে সে সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হলো আমি মাঝে মাঝে সেটা নিয়ে ভেবেছি, মনে হয় সেটি ঘটেছে তার বহুমাত্রিক প্রতিভার জন্যে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের জন্যে সে যে-নাটকগুলো লিখেছে তার জনপ্রিয়তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমি তখন দেশের বাইরে, তাই নিজের চোখে দেখিনি কিন্তু শুনেছি যখন টেলিভিশনে তার নাটক দেখানো হতো তখন বাংলাদেশের পথঘাট নাকি জনশূন্য হয়ে যেতো। মনে হতো বুঝি কারফিউ দেয়া হয়েছে। তার নাটকের চরিত্রকে ফাঁসি দিয়ে যেন মারা না হয় সেজন্য দেশে আন্দোলন হয়েছিল। চলচ্চিত্র তৈরি করার তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, তারপরও সে অসাধারণ কিছু ছবি তৈরি করেছিল। প্রকৃতির জন্যে গভীর একটি মায়া ছিল, বড়ো ছেলে নুহাশের নামে সে নুহাশ পল্লী তৈরি করেছে; সেটি এই দেশের মানুষের কল্পনার একটি ভূখণ্ড। সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানে না আমরা জানি, সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারত আর চমৎকার ম্যাজিক দেখাতে পারত। সবচেয়ে বড়ো কথা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে তার মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর এক ধরনের ভালোবাসা ছিল। একটা সময় ছিল যখন টেলিভিশনে মানুষের মুখে রাজাকার শব্দটি উচ্চারিত হওয়া নিষিদ্ধ ছিল, তখন সে টিয়াপাখির মুখে তুই রাজাকার কথাটি টেলিভিশনে উচ্চারিত করিয়েছিল। তরুণ প্রজন্মকে সে জোছনার আলো আর আকাশ ঝাপিয়ে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। তরুণ তরুণীদের সে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। সম্ভবত সে-কারণেই তার ভক্ত শুধু ভালো কিছু বোদ্ধা পাঠকের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার জন্যে এই দেশের সকল স্তরের মানুষের ছিল গভীর এক ধরনের ভালোবাসা।
আমি সেই ভালোবাসার কথা জানতাম কিন্তু সেটি যে কত গভীর কিংবা কত বিস্তৃত সেটি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। তার মৃত্যুর পর আমি প্রথমবার সেটি অনুভব করতে পেরেছিলাম। একজন লেখকের জন্যে একটি দেশের মানুষ এত গভীরভাবে, এত তীব্রভাবে ভালোবাসা পেতে পারে সারা পৃথিবীতে সম্ভবত তার খুব বেশি উদাহরণ নেই। আমি নিজে নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে তখন জানতে পারিনি, পরে শুনেছি তাকে সমাহিত করার পুরো বিষয়টি কয়েকদিন টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই দেশের সকল মানুষ টেলিভিশনের সামনে বসে সেটি দেখেছে।
তার জনপ্রিয়তার বিষয়টি একটু বিস্তৃতভাবে বলছি কারণ এই উপলব্ধির সঙ্গে এই বইটি প্রকাশনায় একটি সম্পর্ক আছে। হুমায়ূন আহমেদ যখন এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লিখেছে তখনো সে প্রকৃত হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠেনি। লেখাটির মাঝে দুর্বলতা আছে, ছেলেমানুষী আছে, ভুল তথ্য আছে, প্রচুর বানান ভুল আছে–হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এটিকে ছাপার অক্ষরে দেখাতে চাইত কি না আমার জানা নেই। কিন্তু তার জন্যে এই দেশের মানুষের এত গভীর আগ্রহ রয়েছে যে, আমার মনে হয়েছে তরুণ হুমায়ূন কেমন করে লিখত সেটি হয়তো তাদেরকে দেখতে দেয়ার একটি সুযোগ করে দেয়া দরকার। প্রায় অর্ধশত বছর আগে লেখা কাগজগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে, লেখা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তারপরও আমি এই বইয়ে ভুলভ্রান্তিসহ তার নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি তুলে দিয়েছি।