শুনেছি, কিন্তু জীনটা কি রকম হয়?
বলে।
দিলীপ ভয়ে ভয়ে বলল, ভূতদের হিন্দু-মুসলমান আছে?
মনে হয় আছে।
ওদের রায়ট হয়? কাটাকাটি হয়?
ফজলু মাথা চুলকে বলল, নিশ্চয়ই হয়।
ভূতেরা তখন কি মরে?
ফজলুকে এবারে সত্যিই চিন্তিত দেখাল। অনেকক্ষণ ভেবে বলল, কাটাকাটি হলে কি আর মারে না, কিছু নিশ্চয়ই মরে।
মানুষ মরে হয়। ভূত। ভূত মরে কি হয়?
ফজলু হঠাৎ খুব রেগে—মেগে বলল, তুই চুপ করবি এখন?
দিলীপের মোটেও চুপ করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঠিক তখন আমরা শ্লোগান শুনতে পেলাম। বিরাট বড় একটা মিছিল আসছে। মিছিলের সামনে বড় স্বাধীন বাংলার পতাকা, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে— জয় বাংলা। এই শ্লোগানটা নতুন, আগে কখনো শুনিনি। সব শ্লোগানের দুই অংশ থাকে। একজন বলে প্রথম অংশ, অন্য সবাই তখন বলে দ্বিতীয় অংশ। যে রকম ‘ইয়াহিয়ার চামড়া’ ‘তুলে নেব। আমরা’ কিংবা ‘আমার দেশ তোমার দেশ’ ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এই শ্লোগানে কিন্তু একটাই অংশ। একজন বলে জয় বাংলা, তখন অন্য সবাই বলে জয় বাংলা। শ্লোগানটা সাংঘাতিক। বলার সময়ই মনে হয় দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে।
রাশেদের পিছু পিছু আজকে আমরাও মিছিলের সাথে সাথে গেলাম, গলা ফাটিয়ে জয় বাংলা বলে চেচালাম। বাজারের কাছে দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন রাশেদ থেমে আঙুল দিয়ে আহসান মঞ্জিলের দিকে দেখােল। দেখলাম, দোতলায় জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে কে যেন উঁকি মেরে দেখছে।
কে ওটা?
নিশ্চয় আজরফ আলী।
তুই কেমন করে জানিস?
দেখছিস না। সামনে দাঁড়িয়ে দেখার সাহস নাই। উঁকি মেরে দেখছে।
কেন সাহস নাই?
এত বড় মিছিল, সাহস হবে কেমন করে? আজরফ আলীর তিন বউ জানিস না?
তিন বউ থাকলে কি হয়?
রাশেদ খুবই বিরক্ত হল। বলল, কিছুই দেখি জানিস না। তিন বউ থাকলে কাঠ মোল্লা হয়। যত কাঠ মোল্লা, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী সব পাকিস্তানের পক্ষে জানিস না?
ও।
আমরা যখন মিছিলের সাথে সাথে খান বাহাদুরের বাসার কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম রাশেদ তখন আবার দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বললাম, কি দেখছিস?
খান বাহাদুর নিশ্চয়ই লুকিয়ে দেখছে।
কি দেখছে?
মিছিলটিাকে। পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলো তো স্বাধীন বাংলা একেবারে সহ্য করতে পারে না। তুই যদি কানের কাছে গিয়ে বলিস ‘জয় বাংলা’ দেখবি সব চুল আর দাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে রাগে।
আমরা মিছিল থেকে বের হয়ে রাশেদের সাথে র্দাড়িয়ে গেলাম। মিছিলটি যখন চলে গেল তখন দেখলাম, খান বাহাদুর আস্তে আস্তে ভিতর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রাশেদ ঠিকই বলেছে, রাগে মুখ থম-থম করছে। মনে হচ্ছে পারলে পুরো মিছিলটিাকে ধরে কঁচা খেয়ে ফেলেন।
ফজলু বলল, একটা ঢেলা মারব নাকি?
ধুর! ঢেলা মারবি কেন?
আমরা আরো খানিকক্ষণ খান বাহাদুরের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে ५4ठाभ।
পরের কয়দিন খুব দুশ্চিন্তায় কাটল। সত্যি সত্যি যদি ইয়াহিয়া খান আর ভুট্রো মিলে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের পুরো ক্ষমতা দিয়ে দেয়, তাহলে তো আর স্বাধীন বাংলা হবে না, পাকিস্তানই থেকে যাবে। রাশেদ অবিশ্যি ক্রমাগত বলে যাচ্ছে সেটা
কিছুতেই হতেই পারে না। ইয়াহিয়া খান যত বড় বদমাইশ ভূট্রো নাকি তার থেকে একশগুণ বড় বদমাইশ। পুরোটা নাকি একটা চাল অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, কিছুতেই বাঙালীদের ক্ষমতা দেবে না। আমরা সেটাই আশা করে আছি, মিটিং ভেঙে যাবে। আর বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোর পাছায় লাথি মেরে বলবেন, দূর হ তোরা। পাকিস্তানে বসে এখন আঙুল চুষ আজ থেকে আমাদের স্বাধীন বাংলা।
আমাদের ছোট শহরটা অবিশ্যি এর মাঝে স্বাধীন বাংলা হয়ে গেছে। সব দোকানে, সব বাসায় একটা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। যেখানেই যাই সেখানেই বঙ্গবন্ধুর ছবি। ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’ আমরা সবাই আশা করে আছি, এবারে শুধু একটা ঘোষণা, তারপরই পাকাপাকি স্বাধীন হয়ে যাব আমরা। স্কুলে আর উর্দু পড়তে হবে না।
মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখে গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল। খুব হৈ-চৈ হচ্ছে চারদিকে, বাসার ভিতরে ছুটাছুটি, বাইরে মাইকে কি যেন বলছে। আমি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, অন্ধকারে আব্বা আর আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আব্বা?
আব্বা কোন উত্তর দিলেন না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বাবা। ঢাকায় মিলিটারীরা আক্রমণ করছে, হাজার হাজার মানুষকে নাকি মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ হচ্ছে এখন।
কারা যুদ্ধ করছে বাবা?
বাঙালীরা। পুলিশ। ই. পি. আর. ছাত্র।
মাইকে একজন লোক খুব উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে কথা বলতে বলতে রিকশা করে যেতে থাকে। সে বলেছে, ভাইসব! ভাইসব! সারা দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার সমস্ত শক্তি নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ এখন ঢাকায় পথেঘাটে লুটিয়ে পড়ে আছে। বীর পুলিশ বাহিনী এবং ই. পি. আর তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ . . .
লোকটার কথা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।
ঘুম থেকে উঠে সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় ভিড়। আমার বুকের ভিতর কেমন জানি করতে থাকে। ভয়, আতংক, উত্তেজনা আর তার সাথে সাথে কেমন জানি আশ্চর্য একটা আনন্দ।