রাশেদ মাথা নাড়ল, বলল, দেবে না। কিছুতেই দেবে না।
আমরা শফিক ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম খুব গম্ভীর হয়ে। দেশের সামনে এত বড় একটা বিপদ, তার মাঝে তো আর হাসােহাসি করতে পারি না। আমরা হেঁটে হেঁটে আমাদের বাসার কাছে চলে এলাম। বাসার সামনে দেয়ালে চুন বালি খসে পড়েছে। দেয়ালের ফোকড়ে পা দিয়ে উপরে উঠে পা বুলিয়ে বসে থাকলাম গম্ভীর হয়ে। বসে বসে আমরা দেশের কথা ভাবছিলাম, তখন দেখি আশরাফ তার ক্রিকেট বল আর ব্যাট নিয়ে এসেছে। আশে-পাশের বাসা থেকে আরো ছেলেপিলেরা বের হয়ে এল। আমরা তখন মাঠে ক্রিকেট খেলতে শুরু করলাম, দেশের বিপদের কথা ভুলে গেলাম একটু পরেই।
বিকেল পড়ে এলে রাশেদ বলল সে এখন যাবে। ক্রিকেট খেলায় রাশেদ একেবারে যাচ্ছেতাই। না পাৱে বোলিং, না পারে ব্যাটিং। শুধু তাই না, ফিল্ডিংয়ের সময়ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবে সেই জানে, হাতের কাছ দিয়ে বল গড়িয়ে যায়, ধরতে মনে থাকে না।
আমি রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাসা কোথায়?
অনেক দূর। ব্রীজের কাছে।
তাহলে চলে যা। বাসায় যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে।
বাসায় যেতে দেরি আছে আমার।
কোথায় যাবি?
মশাল মিছিল আছে রাত্ৰিবোলা।
তুই মশাল মিছিলে যাবি?
হ্যাঁ। ছোট বলে হাতে মশাল দিতে চায় না। আগে গিয়ে অনেক সাধাসাধি করতে হবে।
ফজলু চোখ ছোট ছোট করে বলল, ইশ! আমি যদি তোর সাথে যেতে পারতাম!
রাশেদ বলল, চল যদি যেতে চাস।
ফজলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দিলীপ বলল, ফজলু যাবে মশাল মিছিলে? তাহলেই হয়েছে! কাকা তোকে পিটিয়ে লম্বা করে দেবে না?
ফজলু বিষগ্ন মুখে মাথা নাড়ল। আশরাফ গম্ভীর গলায় বলল, বড় না হওয়া পর্যন্ত মিছিলে যোগ দেয়া ঠিক না। রাজনৈতিক দল ভুলপথে নিয়ে যাবে।
রাশেদ আবার বড় মানুষের মত বলল, পথে তো নামতে হবে। আগে, না হলে জানবি কেমন করে কোনটা ভুলপথ কোনটা ঠিক পথ?
রাশেদ যাবার আগে তার স্কুলের বই-খাতা আমাকে দিয়ে গেল কালকে স্কুলে নিয়ে যাবার জন্যে। আশরাফ তার ব্যাট আর বল নিয়ে বাসায় গেল, দিলীপ আর ফজলুও চলে গেল তাদের বাসায়, অন্যেরা আগেই চলে গিয়েছে। আমি খানিকক্ষণ একা একা মাঠে বসে থেকে বাসার দিকে রওনা দিলাম। শফিক ভাইয়ের ঘর অন্ধকার, তার মানে বাসায় নেই। কে জানে রাশেদের মত মশাল মিছিলে গিয়েছে কি না। অরু, আপাদের বাসায় দেখি বারান্দায় অরু, আপা আর তার আম্মা দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। আমাকে দেখে অরু আপা গলা উচিয়ে বললেন, এই ইবু, এখন বই-খাতা নিয়ে কোথায় যাস?
আমার বই-খাতা না।
কারা?
রাশেদের। মশাল মিছিলে গেল, তাই আমাকে দিয়েছে।
এইটুকুন পিচ্চি মশাল মিছিলে গেল? হ্যাঁ, বলে কি?
হ্যাঁ।
বাসায় গেলে তার বাবা বানাবে না?
না। রাশেদ আর তার বাবা খুব বন্ধু!
মজা তো দেখি! এরকম বাধা হলে খারাপ হয় না, কি বলিস?
রাশেদ বলেছে, তার বাবা নাকি একটু পাগল কিসিমের।
একটু কি বলছিস? মনে তো হয় পুরোটাই, না হলে এইটুকু পিচ্চিকে রাত্রিবেলা মশাল মিছিলে পাঠায়?
আমি চলে যাচ্ছিলাম, অরু আপা আবার ডাকলেন, এই ইবু, আয়, লজেন্স খাবি?
লজেন্সের কথা শুনে আমি একটু নরম হয়ে গেলাম। অরু আপা মানুষটা খারাপ না। কিন্তু মাথায় মনে হয় একটু ছিট আছে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার হাতে কয়েকটা লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন, খেয়ে দ্যাখ, অনেক মজা।
অরু আপার আম্মা বললেন, তোমার আম্মা ভাল আছেন, ইবু?
জ্বী খালাম্মা।
আসতে বল একদিন। আমি ঘর থেকে বের হবার সময় পাই না।
বলব খালাম্মা।
অরু আপা বললেন, এই ইবু তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি, ঠিক জবাব দিবি?
আমি ঘামতে শুরু করলাম, এই বুঝি আবার অরু আপার পাগলামি শুরু হল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি?
আমাকে তোর পছন্দ হয়?
আমি ঢোক গিলে বললাম, হয়।
আমাকে বিয়ে করবি?
যাও। খালি ঠাট্টা।
ঠাট্টা কখন করলাম, সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করছি। কারবি? আমি তোর জন্যে ভাত রান্না করে দেব। তুই যখন বুড়ো হবি তোর মাথা থেকে পাকা চুল তুলে দেব। করবি?
যাও!
অরু আপার আম্মা বললেন, কেন জ্বালাচ্ছিস ছেলেটাকে?
কে বলল জ্বালাচ্ছি! তোমার জামাই, মা দেখা পছন্দ হয় কি না। তুমি মাছের মাথা
রান্না করে খাওয়াবে। ইবু, তুই মাছের মাথা খাস তো?
যাও অরু আপা, তোমার খালি ঠাট্টা।
দেখিম, আমি তোৰ অনেক যত্ন করব। প্রত্যেকদিন লজেন্দ নিয়ে আসব। করবি বিয়ে?
অরু আপার আম্মা হাসি চেপে বললেন, কেন জ্বালাচ্ছিস ইবুকে! ছেড়ে দে, এখন সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।
খালাম্মা ভিতরে চলে যাবার পর অরু, আপা মনে হল আরো মজা পেয়ে গেলেন। আমার মুখের কাছে মাথা নামিয়ে বললেন, দেখ না— আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। আমার চেহারা কি খারাপ?
খারাপ কেন হবে?
তাহলে রাজি হচ্ছিস না কেন?
তুমি আমাকে বিয়ে করবে না। কচু!
কেন করব না?
তুমি কত বড় আমি কত ছোট! তাছাড়া–
তাছাড়া কি?
তাছাড়া তুমি কাকে বিয়ে করবে সেটা আমি জানি।
কাকে?
শফিক ভাইকে।
অরু আপা চমকে উঠে এদিকে সেদিকে তাকালেন তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে বললেন, কাউকে যদি বলেছিস একেবারে মাথা ভেঙে ফেলব।
ঠিক আছে বলব না। কিন্তু ঠিক বলেছি কি না?
চুপ! চুপ দুষ্ট পাজী ছেলে।
আমি দাঁত বের করে হাসলাম। এতদিনে অরু, আপাকে শায়েস্তা করার মত একটা জিনিস পাওয়া গেছে।
রাত্রিবেলা আমাদের বাসার খুব কাছে দিয়ে মশাল মিছিল গেল। হাজার হাজার মানুষ, মশাল হাতে তাদের কেমন জানি রহস্যময় দেখায়। আমি রাশেদকে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না, এত ভিড়ের মাঝে পাওয়ার কথাও না।