দিলীপ বলল, চল যাই শফিক ভাইয়ের কাছে।
চল।
আমার হেঁটে হেঁটে শফিক ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা দিলাম।
শফিক ভাই তাদের বাসার দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে অরু আপার সাথে গলপি করছিলেন। অরু আপা এখানকার মেয়েদের কলেজে পড়েন, আই এ, না কি বি. এ. আমার মনে থাকে না। অরু, আপা শফিক ভাইদের পাশের বাসায় থাকেন। আগেও দেখেছি দুজনে খুব গল্প করতে পছন্দ করেন। আমাদের দেখে অরু অপি চোখ বড় বড় করে বললেন, ও মা! আমাদের হারু পার্টি দেখি এখানে।
আমরা না শোনার ভান করে হেঁটে গেলাম। গতবার আমরা যখন ফুটবলের টিম খুলেছিলাম, অরু আপা রাত জেগে আমাদের টিমের জন্যে জার্সি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সব জায়গায় গোল খেয়ে আমাদের হারু পার্টি নাম হয়ে গিয়েছিল বলে আজকাল আর ফুটবল খেলি না। অরু আপা আমাদের দেখলেই সেটা মনে করিয়ে দেন। আবার ডাকলেন পিছন থেকে, গোল খাওয়ায় ওয়ালৰ্ড রেকর্ড হতে আর কত দেরি?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ইয়ারকি মেরো না। অরু, আপা।
ইয়ারকি মারলাম। কখন? এত কষ্ট করে জার্সি তৈরি করে দিলাম, সেটা পরে খেলতে গিয়ে শুধু গোল খেয়ে এসেছিস। কোনদিন কি একটা গোল দিয়েছিস কোথাও? দিয়েছিস?
শফিক ভাই আমাদের বাচালেন, বললেন, কেন জ্বালােচ্ছ ওদের অরু? গোল দেয় নাই তো দেবে, পরের খেলায় দেবে। অন্য টিম যদি এত ফাউল করে খেলে এদের দোষ কি?
আমরা জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। শফিক ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি খবর তোমাদের? কই যাও?
আপনার কাছে এসেছিলাম।
ফজলু যোগ করল, একটা বিশেষ কাজে।
দিলীপ অরু, আপার দিকে আড়াচোখে তাকিয়ে বলল, একটা বিশেষ গোপন কাজে।
অরু, আপা চোখ পাকিয়ে বললেন, তার মানে তোরা আমার সামনে কলবি না?
আমরা মাথা নাড়লাম, না।
শফিক ভাই বললেন, আস তাহলে আমার ঘরে।
আমরা শফিক ভাইয়ের পিছু পিছু তাদের বাসায় যাচ্ছিলাম। অরু আপা পিছন থেকে বললেন, এর পরের বার যদি হারু পার্টির জার্সির জন্যে আমার কাছে আসিস, মাথা ভেঙে দেব।
কাজটা ভাল হল না। কিন্তু কি আর করা যাবে!
শফিক ভাই তার চাচার বাসায় থাকেন। ঠিক আপনি চাচা নয়, দূর সম্পর্কের চাচা। বাসার বাইরের দিকে একটা ছোট ঘর শফিক ভাই ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। আমরা তার ঘরে গিয়ে দেশের উন্নতির জন্যে একটা ওষুধের কারখানা খোলার কথাটা খুলে বললাম। শফিক ভাই খুব গম্ভীর হয়ে শুনলেন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি অরু আপা থাকলে এতক্ষণে এটা নিয়ে হাসি—তামাশা করে একটা কাণ্ড করতেন।
ফজলু বলল, শফিক ভাই ওষুধ কেমন করে বানাতে হয় আপনাকে বলে দিতে হবে।
একশ বার। শফিক ভাই মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু আমি তো আগে কখনো ওষুধ তৈরি করিনি। আগে কিছু বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
তাহলে করেন।
করব। করে যখন বের করব তখন তোমাদের বলব। কি রকম ওষুধ বানাতে চাও? হোমিওপ্যাথিক না এলোপ্যাথিক?
আমি মাথা চুলকালাম, কোনটা ভাল?
ফজলু বলল, হোমিওপ্যাথিকটা খেতে ভাল।
দিলীপ বলল, কিন্তু এলোপ্যাথিক বেশি কাজের।
তাহলে এলোপ্যাথিকই হোক।
শফিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, টেবলেট না ক্যাপসুল?
আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। দিলীপ জিজ্ঞেস করল, কোনটা সোজা?
মনে হয় টেবলেট।
তাহলে টেবলেট দিয়েই শুরু করি।
ঠিক আছে।
শফিক ভাইয়ের সাথে খুটিনাটি জিনিস নিয়ে আরো খানিকক্ষণ কথা বলে আমরা যখন চলে আসছিলাম, হঠাৎ শফিক ভাই বললেন, দেশের অবস্থা খুব খারাপ সেটা জান?
আমরা কিছু বলার আগেই রাশেদ বলল, জানি।
কি জান?
ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালীদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না।
শফিক ভাই একটু অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকালেন, আমরাও তোকালাম। রাশেদ একেবারে বড় মানুষের মত কথা বলছে। শফিক ভাই বললেন, তুমি কেমন করে জানি বাঙালীদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না?
পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করে বেঁচে থাকে। আমরা ক্ষমতায় গেলে আর শোষণ করতে পারবে না।
শফিক ভাই এবারে মনে হল আরো অবাক হলেন। বললেন, তোমাকে তো আগে দেখিনি।
আমি বললাম, নতুন এসেছে আমাদের ক্লাসে।
কি নাম তোমার?
রাশেদ হাসান।
আমি বললাম, তার আগের নাম ছিল লাড্ডু।
লাড্ডু।
রাশেদ একটু হেসে বলল, এখন আমার নাম রাশেদ।
রাশেদ, তুমি তো কেশ খবরাখবর রাখ দেখি।
আমি বললাম, হ্যাঁ, রাশেদ সব সময় তার বাবার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে।
শফিক ভাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, শেখ মুজিবকে যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে কি হবে বলে তোমার মনে হয়?
ফজলু হি হি করে হেসে বলল, গৃহযুদ্ধ আবার কি? ঘরের মাঝে যুদ্ধ? বাবার সাথে মায়ের?
দূর বোকা— শফিক ভাই বললেন, একটা দেশের নিজেদের ভিতরে যখন যুদ্ধ হয় তাকে বলে গৃহযুদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তান যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে সেটা হবে গৃহযুদ্ধ।
দিলীপ ভয়ে ভয়ে বলল, সত্যি হবে গৃহযুদ্ধ?
শফিক ভাই আস্তে আস্তে বললেন, আমার মনে হয় হবে। আমার মনে হয়, পশ্চিম পাকিস্তান কখনো শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেবে না— যদিও শেখ মুজিব বেশি সিটি পেয়েছেন তবু তাকে ক্ষমতা দেবে না— কারণ তাহলে আর ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে না। কিন্তু বাঙালীরা আর কখনো সেটা চুপ করে মেনে নেবে না। কিছুতেই নেবে। না।
কি করবে?
আন্দোলন করবে। আসলে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। অসহযোগ আন্দোলন। দোয়া করা যেন আন্দোলনে কাজ হয়। যেন এমনিতেই ক্ষমতা দিয়ে দেয়।