রাশেদ হেসে উড়িয়ে না দিয়ে মুখটা আরো গভীর করে বলল, কিছুই তো জানি না। কাচু ভাইয়ের যা মাথা গরম!
তুই কি তোর কাছু ভাইকে কাদেরের কথা বলেছিলি?
বলতে চাই নাই, কিন্তু জোর করলেন- রাশেদ মুখ সূচালো করে বসে থাকে।
ফজলু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যি মার্ডার করে ফেলেছেন?
রাশেদ উত্তর না দিয়ে খুব হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে।
আমাদের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। কি সর্বনাশা। কথা ! রাশেদকে পিটিয়েছে বলে কাদেরকে মার্ডার করে ফেলেছে? আমরা গুটিশুটি মেরে বসে থাকি, ক্লাসে মন দিতে পারি না। যখন থানা পুলিশ হবে তখন কি সবাইকে বলতে হবে না? কেমন করে মার্ডার হল কাদের? ডেডবডি কোথায় ফেলেছেন রাশেদের কাছু ভাই, যিনি সকালে চারটা করে কাঁচা ডিম খান।
পরদিন অবশ্যি কাদের ক্লাসে হাজির হল। প্রথমে আমরা তাকে চিনতে পারলাম না। কাদেরের মাথায় ছিল ফ্যাসনের চুল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সে চিরুণী দিয়ে চুল আঁচড়াতো গভীর মনোযোগ দিয়ে। চুলের গোছা তার কপালের উপর ঝাউগাছের মত উচু হয়ে থাকত। কাদেরের মাথায় সেই চুলের চিহ্ন নেই, পুরো মাথা ন্যাড়া চকচকে বেলের মত। দেখে আমরা একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। কাদের মাথা ন্যাড়া করে ফেলবে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।
ফজলু চোখ কপালে তুলে বলল— তোর চুল?
কাদের মেঘের মত স্বরে বলল, চুপ শালা।
ফজলু আর কিছু বলার সাহস পেল না। আমি গলা নামিয়ে বললাম, আমরা ভেবেছিলাম তুই মার্ডার হয়ে গেছিস।
কাদের আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, একটা কথা বললে তোকে মার্ডার করে দেব।
দিলীপ বলল, মাথা ন্যাড়া করেছিস কেন? তোর বাবা ভাল আছেন তো?
চুপ শালা মালাউন।
রাশেদ বলল, তোর কপাল ভাল, শুধু চুলের উপর দিয়ে গেছে। কাচু ভাইয়ের যা মাথা গরম!
কাদের কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। যারা জোককে ভয় পায় তাদের পায়ে জোক কামড়ে ধরলে তারা যেভাবে জোকের দিকে তাকায় ঠিক সেভাবে সে রাশেদের দিকে তাকাল। চোখের মাঝে একই সাথে ভয় আর ঘেন্না ! তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রাশেদকে তার আর স্পশ করারও ইচ্ছে নেই।
কাদের এর পর আর কোনদিন রাশেদকে কিংবা আমাদেরকেও উৎপাত করেনি।
০৩. বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি
বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমি রাশেদকে বললাম, আমাদের পাড়ায় যাবি?
কি আছে তোদের পাড়ায়?
আমরা আছি।
আমরা কারা?
আমি, ফজলু, দীলিপি। আশরাফও আছে।
ফজলু মনে করিয়ে দিল, কাদেরও আছে।
আমি হি হি কবে হেসে বললাম, কাদের আর কোন দিন তোর ধারে-কাছে আসবে না!
রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, তা ঠিক।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যাবি আমাদের সাথে?
তোরা কি করিস?
খেলি।
কি খেলিস?
ডাকাতি ডাকাতি খেলি। একটা কারখানা আছে, সেটাতেও খেলি।।
কারখানা? কিসের কারখানা?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, এখনো ঠিক করি নাই গাড়ির কারখানা না হয় ওষুধের কারখানা। এখন অবিশ্যি খালি বিস্কুটের।
রাশেদ চোখ বড় বড় করে বলল, তোরা বিস্ত্ৰকূট বানাতে পারিস? কি দিয়ে বানাস? মিছিমিছ বিস্ত্ৰকূট?
না না, সত্যি বিস্কুট।।
দিলীপ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, বিস্ত্ৰকূট না কচু! আটার মাঝে চিনি মিশিয়ে চুলার মাঝে গরম করলেই যেন বিস্কৃঢ় হয়।
আমি বললাম, একবারেই সব হবে নাকি? আস্তে আস্তে হবে।
দিলীপ আবার মুখ বাকী করে বলল, মিষ্টি রুটির মত খেতে, হ্যাক থুঃ!
ফজলু একাই সবগুলি বিস্ত্ৰকূট খেয়ে ফেলেছিল, দিলীপের কথা শুনে গরম হয়ে বলল, হ্যাক থুঃ মানে? খেয়ে দেখেছিস?
রুটির মত নরমা লুতা লুতা। ময়লা কাল—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, খাবার সোড়া দিতে হবে পরের বার। খাবার সোডা দিলে মুচমুচে হয়।
ফজলু বলল, আটা না দিয়ে ময়দা দিতে হবে। তাহলে দেখতে ভাল হবে।
দিলীপ তখনো মুখ কুঁচকে রেখেছে, মাথা ঝাকিয়ে বলল, কেরোসিনের গন্ধ —
ফজলু মহা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই চুপ কর দেখি। সব কাজে শুধু সমালোচনা।
দিলীপের এত সমালোচনার পরও রাশেদকে বিস্কুটের কারখানায় খুব উৎসাহী দেখা গেল। বলল, ভাল করে যদি সত্যি সত্যি বিস্ত্ৰকূট বানাতে পারিস অনেক কাজ দেবে। তাই না?
কি কাজ দেবে?
দেশের সব গরিব বাচ্চাদের সকালে নাস্তা খাওয়ানোর জন্যে দেয়া যাবে।
আমাদের তখন মনে পড়ল, রাশেদ রাজনৈতিক মানুষ। সে সব সময়ই দেশের সব মানুষের কথা ভাবে। আমরাও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লাম, তা ঠিক।
ফজলু পর্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে আগে ওষুধের কারখানা তৈরি করতে হবে। দেশের মানুষের দরকার ওষুধ। বিস্কট না খেলে কি হয়? কিন্তু অসুখ হলে ওষুধ খেতেই হয়।
দিলীপ আবার ঠোঁট উল্টে বলল, তোরা ওষুধ বানাবি? তোরা?
কেন, অসুবিধা কি?
কিসের ওষুধ?
জ্বর, সর্দি আর কাশি। সাথে মাথাব্যথা।
ফজলু যোগ করল, এবং পেটের অসুখ।
কেমন করে বানাবি?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, কেন, শফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করব। শফিক ভাই বলে দেবে।
দিলীপ চুপ করে গেল। শফিক ভাই পারেন না। এমন কোন কাজ নেই। চুপ না করে উপায় কি? শফিক ভাই আমাদের পাড়ায় থাকেন। কলেজে পড়েন, আই. এস. সি, না যেন বি. এস. সি ঠিক মনে থাকে না। যখনই আমাদের কিছু দরকার হয় আমরা শফিক ভাইয়ের কাছে যাই। শফিক ভাই সব কিছুর একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমাদের পাড়ায় আমরা যখন নাটক করলাম, শফিক ভাই আমাদের মুখোশ তৈরি করে দিয়েছিলেন (ইশঃ সে যে কি দারুণ একটা নাটক হয়েছিল!)। যখন আমরা সাকাসের দল খুলেছিলাম তখন শফিক ভাই আমাদের বিড়ালটাকে রং করে বাঘ তৈরি করে দিয়েছিলেন (একেবারে খাটি বাঘ, শুধু যদি মিয়াও করে না ডাকত!)। আমরা যখন ল্যাবরেটরী তৈরি করেছিলাম তখন শফিক ভাই লিটমাস পেপার আর চুম্বক এনে দিয়েছিলেন (কত যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমরা করেছিলাম!)।