টিফিনের ছুটিতে কাদের রাশেদকে জানালার নিচে চেপে ধরে বলল, এই ফাডুব বাটচ
আমার নাম ফাড্ডু না।
আমার সাথে রংবাজি? চাকু মেরে ভূঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব।
রাশেদ সেই অবস্থায় হেসে বলে, দে না দেখি।
কাদের এটাকে তাকে অপমান করার চেষ্টা হিসেবে ধরে নিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে একটা চড় মারে। ব্যথা দেওয়ার থেকে অপমান করার চেষ্টা বেশি।
সাথে সাথে স্মগ্ৰীংয়ের মত রাশেদের পা উঠে যায়। বিদ্যুৎগতিতে সে এত জোরে কান্দেরের তলপেটে লাথি মারে যে কাদের নাক চেপে বসে পড়ে।
এরকম অবস্থায় পালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রাশেদ পালানোর কোন চেষ্টা করল না। বরং কাদেরের কাছে দাঁড়িয়ে বড় মানুষদের মত উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে বলল, মারপিট করা ঠিক না। মারপিট করে কোন সমস্যার সমাধান হয় না—
কাদেরের জন্যে এটাই বাকি ছিল। চিৎকার করে উঠে সে বাঘের মত রাশেদের উপর লাফিয়ে পড়ল। কাদের রাশেদ থেকে অন্তত একমাথা উঁচু, ওজন সম্ভবত দুই গুণ, বয়স অন্তত দেড় গুণ। কাদেরকে এখনই বাজারে গুণ্ডা হিসেবে চালানো যায়, তার তুলনায় রাশেদ একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে। দেখে মনে হয়, কান্দেরের সাথে রাশেদের মারপিটের কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মারপিটে গায়ের জোরটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হচ্ছে সাহস। রাশেদের সাহসের কোন অভাব নেই, মনে হয় তার ভিতরে ভয়ের ছিটেফোটাও নেই। কাদের ইচ্ছে করলে তাকে ষে পিষে ফেলতে পারে সে ব্যাপারটা সে জানে না। প্রত্যেকবার ঘুসি খেয়ে সে ফিরে পাল্টা ঘুসি মারছিল। বেকায়দা দুই-একটা এমন মোক্ষম লাথি হাঁকলো যে কাদেরকে পিছিয়ে যেতে হল। কিন্তু রাশেদ এমন মারি খেল যে সেটা বলার মত নয়।
স্কুলে ছোটখাট খামচোখামচি প্রায়ই হয়। কিন্তু বড় ধরনের মারপিট খুব বেশি হয় না। যখন বড় ধরনের মারপিট শুরু হয়, আমরা নিজেরাই ছুটিয়ে দেবার চেষ্টা করি। খুৰ খারাপ অবস্থা হলে স্যারদের ডাকতে হয়। আজকেও আরেকটু হলে স্যারদের ডাকতে হত। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত টেনে কাদের আর রাশেদকে আলাদা করে দিতে পারলাম। কাদেরকে বেশ কয়েকজন মিলে ধরে রাখতে হচ্ছিল, বাগে সে ফোসফোর্স করছে ক্ষ্যাপা মোষের মত। রাশেদের কথা ভিন্ন, রক্তমাখা খানিকটা থুতু ফেলে কিছুই হয়নি এরকম শান্ত স্বরে বলল, মারপিট করা ঠিক না। আর করতেই যদি হয় সমান সমান মিলে মারপিট করতে হয়। তোর হাতির মত সাইজ, মারপিট করার ইচ্ছা করলে আরেকজন হাতির মত সাইজ খুঁজে বের করে তার সাথে করবি। আমার সাথে কারিস না। লাজার ব্যাপার।
আমরা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা হয়তো স্যারদের কানো যাবে না, কিন্তু হেড স্যারের কানে চলে গেল। হেড স্যার দপ্তর দিয়ে ডেকে পাঠালেন দুজনকে। আমরা বাইরে ঘুর ঘুর করে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম ভিতরে কি হচ্ছে।
হেড স্যারের দুইটা বেত, একটা নাকি ইণ্ডিয়া থেকে আনা হয়েছে, সেটার নাম ‘শিলং ইস্পিশাল’, আরেকটা এসেছে গারো পাহাড় থেকে, সেটার নাম ‘গারো ইম্পিশাল’। স্কুলের দপ্তরী কালিপদ নাকি প্রত্যেক শুক্রবার বেতগুলিতে তিশির তেল মাখিয়ে রাখে। কেউ মারপিট করলে হেড স্যার প্রথমে দুজনকেই শিলং ইম্পিশাল দিয়ে এক চোেট ধোলাই দিয়ে দেন। তারপর দুজনের কথা শুনেন, যে দোষী সাব্যস্ত হয় তাকে গারো ইম্পিশাল দেওয়া হয়। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, কাদের আজ ডাবল ডোজ গারো ইম্পিশাল পাবে কিন্তু দেখা গেল কাদের বেশ হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে হেড স্যারের রুম থেকে বের হয়ে এল। তাকে গারো ইম্পিশাল দেওয়া হয়নি। হেডস্যারের রুমে রাশেদ কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হয়নি। মুখ ফুটে একবার সত্যি কথাটা বললেই কান্দেরের বারটা বেজে যেতো। কাদেরকে স্কুলের সবাই চিনে, হেড স্যার মনে হয় ওঁৎ পেতে থাকেন তাকে ধোলাই দিতে।
বিকেলের দিকে রাশেদের মুখ এবং চোখ বেশ খারাপভাবে ফুলে গেল। হাত দিয়ে টিপে-টুপে আমাকে বলল, এ্যাই ইবু, দেখে কি বোঝা যাচ্ছে?
হ্যাঁ।
বেশি কি বোঝা যাচ্ছে?
হ্যাঁ।
এ্যাহ! খুব খারাপ হল ব্যাপারটা। খুব খারাপ হল।
কি খারাপ হল?
এই যে নাক-মুখ এইভাবে ফুলে গেল !
বেকুবের মতো মারপিট করবি আর মুখ ফুলবে না? তোকে বাসায় আবার বানাবে?
না-না। বাসায় বানাবে কেন?
তাহলে?
রাশেদ খানিকক্ষণ মুখ সূচালো করে থেকে বলল, কাদেরের না কোন ঝামেলা হয়!
কাদেরের? কাদেরের কি ঝামেলা হবে?
কাচু ভাইয়ের যা মাথা গরম!
কাচু ভাই? সেটা কে?
আমাদের পাড়ায় থাকেন। ছত্রিশ ইঞ্চি সিনা। এন-এস-এফের গুণ্ডারা একবার পেটে চাকু মেরেছিল, চাকু পেটে ঢুকে নাই, পিছলে গেছে। সকালে চারটা করে কাচা ডিম খান।
তোর সাথে খাতির আছে?
এক পাড়ায় থাকেন, খাতির থাকবে না? আমাকে খুব মায়া করেন, রাজনীতির খবর দেই তো।
রাশেদ খুব চিন্তিতমুখে বসে থাকে দেখে আমিই ভয় পেয়ে যাই।
পরদিন কাদের স্কুলে এল না। কাদের খুব নিয়মিত স্কুলে আসে না, তাই সেটা নিয়ে কারো খুব মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু রাশেদকে খুব চিন্তিত দেখল। কাদের তার পরদিনও স্কুলে এল না, রাশেদকে তখন আরো বেশি চিন্তিত দেখাল। আমরা তখন আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হল কাদেরের?
জানি না।
তোর কাছু ভাইকে জিজ্ঞেস করিসনি?
করেছি। কিছু তো বলে না।
তোর কি মনে হয়? জানে মেরে ফেলেছে?