ফ্রগম্যান?
হ্যাঁ পায়ে ব্যাঙের পায়ের মত ফ্লীপার লাগিয়ে নদীতে সাঁতরে সাঁতরে যায়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
দিন-তারিখও ঠিক করা আছে কিন্তু সেটা এখনো কেউ জানে না। একটা যুদ্ধ হবে কমলগঞ্জে। অনেক বড় যুদ্ধ। তখন একটা পাকাপাকি ফুণ্ট খুলবে। এখানে। তার আগে আগে যেন কোন সাপ্লাই যেতে না পারে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমি কি বলছি জানিস?
কি?
ব্রীজটা আগেই না উড়াতে। ঠিক যখন একটা মিলিটারী ট্রেন ব্রীজের উপরে থাকবে তখন ‘বুম’! রাশেদ দুই হাত দিয়ে আমার চোখের সামনে ব্রীজটা উড়িয়ে দিল।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, কেমন করে জানবি কোনটা মিলিটারী ট্রেন? ভুল করে যদি প্যাসেঞ্জার ট্ৰেন উড়িয়ে দেয়—
না না সেটা তো করাই যাবে না। রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, ধার কমলগঞ্জে যুদ্ধ শুরু হল। তখন একটা ট্রেন বোঝাই করে মিলিটারী গোলাবারুদ তো। ওদিকে যাবেই। তখন ধর আমরা কেউ যদি স্টেশনে থাকি যখন দেখব ট্রেনটা ছাড়ছে খবর পাঠিয়ে দিলাম, ঠিক যখন বীজের উপর আসবে। — ‘বুম’। রাশেদ আবার বীজটা উড়িয়ে দিল।
কেমন করে খবর পাঠাবি?
সেটা এখনো ঠিক করি নি। দিনের বেলা আয়না দিয়ে —
যদি মেঘলা দিন হয়?
রাশেদ একটু হেসে বলল, সেটা ভেবে একটা কিছু উপায় বের করে ফেলব! মনে নাই শফিক ভাইকে কেমন করে উদ্ধার করলাম।
ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় আমরা দুজনেই একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে হাসতে থাকি। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শফিক ভাই কেমন আছেন এখন?
ভাল, এতদিনে বর্ডারের কাছে পৌছে গেছেন। হাসপাতালে থাকার সাহস পেলেন না। পরদিন ভোরেই একটা রিক্সা নিয়ে বের হয়ে গেলেন, সবার সামনে দিয়ে!
আমি আর রাশেদ আবার আনন্দে হাসতে থাকি। রাশেদ হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, তুই থাকলে খুব ভাল হত। সবাই চলে যাচ্ছে, আমি একা হয়ে গেলাম।
রাশেদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেমন জানি একটা দুঃখী-দুঃখী মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কি করুব বল? ছোট হলে বড় অসুবিধে, সবসময় বড়দের কথা শুনতে হয়।
তা ঠিক।
আমি আর রাশেদ আরো অনেকক্ষণ কথা বললাম, দুজনে হেঁটে হেঁটে গোলাম রাস্তা দিয়ে তারপর আবার ফিরে এলাম। রাশেদ তখন আমাকে চায়ের দোকানো নিয়ে মালাই দিয়ে চা খাওয়ালো। ফিরে আসার সময় রাশেদ হঠাৎ আমার হাত ধরে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, তুই আমার বন্ধু হবি?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কেন? আমি কি তোর বন্ধু না?
একেবারে প্রাণের বন্ধু। সারা জীবনের বন্ধু। মরে গেলেও যে বন্ধু থেকে যায়। সেই বন্ধু। হবি?
আমি মাথা নাড়লাম, হব।
রাশেদ তখন খুশি হয়ে একটু হাসল। ফিসফিস করে বলল। আমার কোন প্রাণের বন্ধু নাই— মানে আগে ছিল না। একজন বন্ধু খুব দরকার যাকে সবকিছু বলা যায়।
সবকিছু কি?
কত কি বলা যায়! তুই কি আমার কিছু জানিস? আমি কে? আমার বাবা কি? কি করে? কিছু জানিস?
আমি মাথা নাডুলাম, না, জানি না।
মাঝে মাঝে আমার কৌতূহল হয়েছে সত্যি কিন্তু কখনো রাশেদকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। রাশেদ একটু হেসে বলল, তুই যখন আমার প্রাণের বন্ধু হলি তোকে কেউ একটুকু কিছু বলবে। আজকাল শুধু ভয় হয় যে কােনদিন কেউ আমরা আর যাব।
তা ঠিক।
রাশেদ হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আমি কোনদিন মরে যাই, তুই আমার কথা মনে রাখবি?
রাশেদ কেন এটা বলল আমি জানি না। কিন্তু আমার বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল, আমি রাশেদের হাত ধরে বললাম, ধুব বেকুব কোথাকার! তুই মরবি কেন?
রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ মরার কথা বলা ঠিক না।
আমরা কত ছোট কিন্তু আমাদের কিনা এখনই মরে যাওয়া বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবতে হয়।
আমরা রওনা দিয়েছি ভোরে। দুটি নৌকায় আমরা আর অরু আপারা ভাগাভাগি করে যাচ্ছি। নৌকাদুটি যাচ্ছে নদীর তীর ঘেঁষে। মাঝে মাঝে মিলিটারী গানবোট এসে পড়ে তখন লুকিয়ে যেতে হয়, কাছাকাছি কোন ছোট খাল থাকলে সেখানে ঢুকে পড়তে হয়। দুটি নৌকা একটা আরেকটার কাছাকাছি যাচ্ছে। দুপুর বেলা এক জায়গায় থেমে নৌকায় কিছু রান্না করা হল খাওয়ার জন্যে। ডালের মাঝে ডিম ভেঙে দিয়ে অদ্ভুত একটা রান্না কিন্তু খেতে খারাপ না। খিদে লাগলে অবশ্যি সবকিছু খেতে ভাল লাগে, নৌকায় সারাদিন শুধু বসেই আছি। তবু দুপুর বেলা ভীষণ খিদে পেয়েছিল।
দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে আবার নৌকা ছেড়ে দিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। আমি নৌকার ছাঁইয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চারিদিকে এক ধরনের সুমসাম নীরবতা। পানির ছলাৎ ছিল।াৎ শব্দ হচ্ছে কিন্তু খানিকক্ষণ বসে থাকলে সেই শব্দ আর কানে আসে না। মনে হয় কোথাও কোন শব্দ নেই। আকাশে তারা উঠেছে। কত লক্ষ লক্ষ তারা, আমি অ্যাবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। একেকটা পৃথিবী থেকে কত কোটি কোটি মাইল দূরে। কত বড় এই বিশাল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড আর পৃথিবী কত ছোট! সেই ছোট পৃথিবীতে আমরা নিজের দেশের মানুষ নিজের দেশে নিজের ঘর বাড়িতে থাকতে পারি না। তাড়া খেয়ে বনের পশুর মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়!
নৌকা দুটি বড় নদী থেকে বাঁক নিয়ে ছোট একটা নদীতে ঢুকে পড়ল। মাঝি হালকা গলায় বলল, আর ভয় নাই গো!
অরু আপা নৌকার ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ভয় নাই?
পাঞ্জাবী গো ভয় নাই। এটা নীল গাং।। নীল গাংয়ে গানবোট ঢুকে না।