আমি বললাম, লাগতেই তো পারে।
কি মনে হয়? ঠিক ঠিক হবে তো সব কিছু?
একশবার হবে : আশরাফ বুকে থাবা দিয়ে বলল, দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে এসেছি আজ।
আমি আশরাফকে বললাম, দে তোর বলটা।
আশরাফ আমাকে বলটা দেয়। আমি বললাম, দেখা হবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
ফজলু দাঁত বের করে একটু হাসার চেষ্টা করল, আশরাফ কিছু বলল না।
আমি আমার গল্পের বই এবং আশরাফের বলটা নিয়ে হাসপাতালের রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। হাসপাতালের ঠিক সামনে দিয়ে বড় রাস্তােটা গিয়েছে, রাস্তার অন্য পাশে একটা পুকুর। পুকুরের পাশে একটা গোরস্থান। হাসপাতালের এত কাছে একটা গোরস্থান রাখা মনে হয় ভাল কাজ হয় নাই। রোগীদের মন দুর্বল হয়ে থাকবে সারাক্ষণ, কিন্তু আমাদের প্ল্যানটা কাজে লাগাতে খুব সুবিধে হয়েছে। গোরস্থানটা অনেক পুরোনো, দেয়াল জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়েছে ভিতরে গাছ পালায় ঢাকা, দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে। গােরস্থানের অন্য পাশে বস্তির মত, কিছু দিনমজুর ছোট ছোট ঝুপটির মত ঘরে থাকে। তার অন্য পাশ দিয়ে আরেকটা রাস্তা নদীর ঘাটের দিকে গিয়েছে। আমি গোরস্থানের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখলাম। কেউ নেই এবং কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে না। আমার হয়তের বল এবং বইগুলি ভিতরে ফেলে দিলাম। এটা আমাদের প্ল্যানের একটা অংশ।
গোরস্থানে কাজ শেষ করে আমি হাসপাতালে ফিরে এলাম। বেশি আগে এসে লাভ নেই তাই একটু ঘুরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে ছয়টা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে হাসপাতালে এসেছি। একা একা না। ঢুকে কিছু মানুষের সাথে ঢুকে গেলাম। ভাবখানা তাদের সাথে এসেছি। ভিতরে ঢুকে হাসপাতালের বড় একটা ওয়াড়ে নিজীব দেখে একজন রোগী বের করে তার বিছানার কাছে বসে রইলাম। ভাবখানা তার সাথে দেখা করতে এসেছি। বসে থাকতেই ডাক্তার সাহেবকে দেখলাম, রোগীদের দেখে দেখে যাচ্ছেন। আমাকে দেখলেন, দেখে চিনতে পারলেন বলে মনে হয় না। খানিকক্ষণ পর ফজলুকে দেখলাম আরো কোণায়, আরো কয়জন মানুষের পিছনে পিছনে এসে ঢুকছে। আশরাফকে দেখলাম, করিডোর ধরে হেঁটে গেল, নিশ্চয়ই নিচে কোথাও অপেক্ষা করবে। রাশেদকে দেখলাম না। তার কাছেই ষ্টেনগান, সেই সবচেয়ে জরুরী। যদি কোন কারণে না আসতে পারে আমাদের পুরো প্ল্যানটাই ভঙুল হয়ে যাবে। আমি বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। লোকজন যাচ্ছে, আসছে। কেউ আমাকে বা ফজলুকে লক্ষ্য করছে না। একটু পরে যখন প্রলয় কাণ্ড শুরু হবে তখন সবাই দেখবে চোখ বড় বড় করে!
শেষ মুহূর্তে রাশেদকে দেখলাম ভিতরে এসে ঢুকল। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ কয়েকটা ক’লা উঁকি দিচ্ছে ভিতর থেকে। নিচে নিশ্চয়ই স্টেনগান আছে। রাশেদ একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে হেঁটে গেল, আমাদের চিনছে সেরকম ভান করল f
আমি রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকি। আর কয়েক মিনিট, তারপর এসে যাবে সেই ভয়ঙ্কর মুহুর্ত। কি হবে তখন? সত্যি কি আমরা পারব শফিক ভাইকে বাঁচাতে? সত্যি কি সব কিছু হবে পরিকল্পনা মৃত? গােলাগুলী কি হবে? কেউ কি মারা যাবে আজ? আমাদের? রাজাকারদের? এখন আর ভেবে লাভ নেই। যা হবার হবে, আমরা শুধু করে যাব যেটা করার কথা।
আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে দিম আটকে যাবে হঠাৎ কান খাড়া করে বসে আছি, আর ঠিক তখন ঢং ঢেং করে ছয়টা বাজিল পেটা ঘড়িতে।
আমি সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম ফজলুও উঠে দাঁড়াল। আশরাফ আর রাশেদ কোথায় আছে জানি না, কিন্তু যেখানে থাকুক এখন নিশ্চয়ই তারাও উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে মনে বললাম, হে খোদা তুমি সব কিছু ভালয় ভালয় শেষ করিয়ে দিও।
আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বাইরে এলাম। করিডোর ধরে হেঁটে এখন দশ সেকেন্ডের মাঝে আমাদের শফিক ভাইয়ের সামনে যাবার কথা। তাড়াহুড়া করার কোন প্রয়োজন নেই। দশ সেকেন্দ্র অনেক সময়। আমি মনে মনে গুণতে থাকি এক হাজার এক, এক হাজার দুই, এক হাজার তিন…
আমি না তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ফজলু আমার পাশে-পাশে হাঁটছে। করিডোর ধরে ঘুরে যেতেই আমরা শফিক ভাইয়ের ঘরটা দেখলাম। ঘরের সামনে রাজাকারটি আমাদের দিকে পিছনে ফিরে বসে আছে। সাথে আর কেউ নেই, এই সময়টাতে পুলিশ দুইজন চলে যায় ফিরে আসে আরেকটু রাতে। সে কারণেই এই সময়টা বেছে নেয়া হয়েছে। রাজাকারটি আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসেছে, তার মানে আগে আমার আর ফজলুর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার বুকের ভিতর হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে উঠে।
সামনে হঠাৎ করে রাশেদ আর আশরাফকে দেখলাম। রাশেদের হাত বাজারে ব্যাগের মাঝে, তার মানে নিশ্চয়ই স্টেনগানটা ধরেছে। হাতে দিয়ে।
আমি আর ফজলু আরেকটু এগিয়ে গেলাম। রাশেদ আর আশরাফ আরেকটু এগিয়ে এল। আমি ফজলুর দিকে তাকলাম, ফজলু আমার দিকে তাকাল তারপর দুজন এক ছুটে রাজাকারটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড ধাক্কায় রাজাকারটি চেয়ার থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ল। হাতে তখনো রাইফেলটা ধরে রেখেছে, এক হ্যাচকে টানে রাইফেটা সরিয়ে নিল ফজলু। আমি গায়ের জোরে একটা লাথি মারলাম লোকটার মাথায়, আরেকটা মারার আগেই রাশেদের হাতে স্টেনগান বের হয়ে এসেছে, হিংস্র। গলায় বলল, শুওরের বাচ্চা চোখ বন্ধ করা।
রাজাকারটি চোখ বন্ধ করল।
ঘরের ভিতর ঢোক— খবরদার মাটি থেকে উঠবি না। একটু উল্টা পাল্টা কিছু করলে গুলী।
রাশেদকে দেখে মনে হল দরকার হলে সত্যি সে গুলী করে দেবে। রাজাকারটি চোখ বন্ধ করে বুকে হেঁটে শফিক ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে থাকে। দেখলাম ভয়ে কঁপিছে সে থারথার করে।