আসতেই রাশেদ আশরাফ আর ফজলু আমার সাথে এক হল। আশরাফ গলা নামিয়ে বলল, কি বললেন?
ঠিক বুঝতে পারলাম না।
কি বুঝতে পারলি না?
মনে হল প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সব কথা যখন শেষ হল। তখন বললেন, আমি রাজি না।
তাই বললেন?
হ্যাঁ, তারপর বললেন তোমাকে এখন ঘড়ি ধরে বের করে দেব।
ঘাড় ধরে?
হ্যাঁ, তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে মনে হল বেশ আদর করেই বাইরে বের করে দিলেন। একবারও কিন্তু রাগ হয়ে কিছু বললেন না।
রাশেদ মুখ কাল করে বলল, কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম ডাক্তার সাহেব জয় বাংলার পক্ষে।
হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেব জয় বাংলার পক্ষে ঠিকই। কিন্তু আমাদের মত বাচ্চাদের সাথে কোন রকম প্ল্যান করতে ব্রাজি না। ভয় পান।
রাশেদ মুখ শক্ত করে বলল, আমরা যদি কিছু না করি শফিক ভাইকে এমনিতেই মেরে ফেলবে। চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। ডাক্তার সাহেবকে ছাড়াই। যখন দেখবেন আমরা কিছু একটা করে ফেলেছি তার আর কোন উপায় থাকবে না।
আমরা মাথা নাড়লাম।
আশরাফ বলল, আমাদের শেষবার গিয়ে হাসপাতালটা দেখে আসা দরকার। যদি প্ল্যানের কোন রদবদল করতে হয়।
হ্যাঁ। রাশেদ বলল, সবার গিয়ে কােজ নেই। দুইজন গেলেই হবে। আমি আর ইবু যাই। তোরা এখানে অপেক্ষ কর।
ঠিক আছে।
আমি আর রাশেদ একজন মেয়ে মানুষের পেছনে পিছনে হাসপাতালে ঢুকে গেলাম। হাসপাতালের ভিতরে ফিনাইলের গন্ধ, এক জায়গায় একটা রোগী চিৎকার করছে। এক পাশে শফিক ভাইয়ের ঘর, বাইরে একটা রাজাকার বসে সিগারেট টানছে। আমরা সেদিকে গেলাম না। অন্য পাশে দরজার কাছে একটা টেবিল তার উপর একটা খালি ষ্ট্রেচার রাখা। আমার হঠাৎ একটা খটকা লাগল, আমাদের প্ল্যান কাজে লাগানোর জন্যে একটা স্ট্রেচার দরকার, ডাক্তার সাহেবকে তাই বলেছিলাম। তিনি আমাদের সাথে রাজি হন নি। কিন্তু ঠিকই একটা স্ট্রেচার রেখেছেন। আমি তাড়াতাড়ি হেঁটে করিডোর পার হয়ে অনড় দিকে গেলাম। ঘরটিতে সারি সারি বিছানাপাত, তার মাঝে দেয়াল থেকে তিন নম্বর বিছানাটা খালি। ঠিক যেরকম ডাক্তার চাচাকে বলেছিলাম।
আমি রাশেদকে খামচে ধরে বললাম, রাশেদ।
কি?
ডাক্তার চাচা সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই দেখ খালি বিছানা! ঐ দেখা স্ট্রেচার!
তাহলে! তোকে যে বললেন রাজি না?
হঠাৎ করে আমি সব বুঝে গেলাম! বললাম, বুঝলি না? আমরা যদি ধরা পড়ে যাই কিছুতেই কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না ডাক্তার সাহেব আমাদের সাথে আছেন।
কেন? মনে নেই আমাকে বলেছেন রাজি না, শুধু তাই না। আমাকে বের করে দিলেন বাসা থেকে।
কিন্তু স্ট্রেচার? খালি বিছানা? হাসপাতালে স্ট্রেচার থাকবে না? একটা বেড়ে খালি হতে পারে না? রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে খুশিতে হেসে ফেলল। তাহলে আমাদের আর কোন সমস্যা নাই!
না।
দুপুরে আমরা সবাই বাসায় ফিরে গিয়ে গোসল সেরে নিলাম। কেউ যদি আমাদের লক্ষ্য করে ঘূণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারবে না। আমরা আর কয়েক ঘন্টার মাঝে কি সাংঘাতিক একটা কাজ করতে যাচ্ছি। কিছু একটা গোলমাল হয়ে যেতে পারে, গোলাগুলী হতে পারে, কেউ একজন মরেও যেতে পারি। কিন্তু সেই সব মাথা থেকে সরিয়ে রেখেছি।
খাবার টেবিলে আম্মা বললেন, কি রে ইবু, তুই এত চুপচাপ কেন?
না, এমনি।
জানিস তো আমরা চলে যাব।
কবে?
এই কাল না হয়। পরশু। ফরহাদ সাহেব, অরুর আব্বা আজ নৌকা ঠিক করেছেন।
ও।
বাইরের খোঁজ খবর কিছু জানিস?
কিসের খোঁজ খবর?
শফিক কেমন আছে, এইসব।
একটু একটু নাকি হাঁটতে পারেন। আমার গলা কেপে গেল। হঠাৎ, কাল পরশুর মাঝে নাকি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে।
আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।
১৭. পাঁচটার দিকে আমি
পাঁচটার দিকে আমি বাসা থেকে বের হলাম। হাতে কয়েকটা গল্পের বই, কোন বইয়ে আমার নাম লেখা নেই। আজগুবি একটা নাম লিখে রেখেছি। বাসা থেকে বের হয়ে ফজলুর বাসায় গেলাম। ফজলুকে নিয়ে আশরাফের বাসায়। আশরাফ একটা বল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। আমার আর ফজলুর খালি পা আশরাফের পায়ে এক জোড়া টেনিশ শু। খালি পায়েই আমরা ভাল দৌড়াদৌড়ি করতে পারি, টেনিস শু, না পরলে আশরাফ নাকি ভাল ছুটতে পাবে না। আমরা সবাই দুটি করে শার্ট পরেছি একটা উপরে আরেকটা নিচে, দুইটা দুই রকম। উপরের শটটা খুললেই ভিতর থেকে অন্য শার্ট বের হয়ে যাবে। বেশ গরম আজকে, দুইটা সার্ট মনে হচ্ছে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। সার্ট ছাড়া আরো একটা জিনিস আছে, পকেট, একটা করে রুমাল। দুই মাথা গিট মেরে একটা টিউবের মত রাখা আছে মাথা দিয়ে গলিয়ে মুখোসের মত পরে নেয়া যাবে। চোখের জায়গা কেটে গত করে রেখেছি, পরার পর দেখতে যেন অসুবিধে না হয়। বাসায় আয়নার সামনে পরে দেখেছি, বিদঘুটে লাগে দেখতে, কেউ আর আমাদের চেহারা দেখতে পারবে না।
হাসপাতালের কাছাকাছি এসে আমরা একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম।
আমি আশরাফ আর ফজলুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার মত ভঙ্গি করলাম, হাসিটা খুব ভাল কাজ করল বলে মনে হল না। রাশেদ আমাদের সাথে নেই, সে স্টেনগান নিয়ে আসবে, সোজাসুজি হাসপাতালে আমাদের সাথে দেখা করার কথা। আশরাফ বলল, এখন তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাই?
হ্যাঁ।
আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। পেটের ভিতরে কেমন জানি করছে— ফাইনাল পরীক্ষার আগে ঠিক যখন প্রশ্ন দেয় তার আগে যেমন লাগে। ফজলু শুকনো মুখে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে।