দুদিন পরে আমরা খবর পেলাম শফিক ভাই এখনো বেঁচে আছেন। শুধু যে বেঁচে আছেন। তাই নয়। তাকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শান্তি কমিটি আর রাজাকাররা তাকে এখনই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানী মিলিটারীরা তাকে আরো কয়দিন বাঁচিয়ে রেখে তার কাছ থেকে কিছু খবর বের করতে চায়। খবর বের করার জন্যে তার উপর অত্যাচার করা হবে। আর মানুষকে অত্যাচার করতে হলে আগে নাকি তাকে সুস্থ করে নিতে হয়। মানুষকে অত্যাচার করার জন্যে সবচেয়ে ভয়ংকর নিয়মগুলি নাকি পাকিস্তানী মিলিটারী থেকে ভাল করে কেউ জানে না। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখে, নখের নিচে গরম সূচী ঢুকিয়ে দেয়, নখ টেনে তুলে ফেলে, ঝুলিয়ে রেখে চাবুক দিয়ে মারতে থাকে আরো কত কি।
আমি আর রাশেদ কয়েকদিন সরকারী হাসপাতালের আশে-পাশে দিয়ে ঘুরে এসেছি। একদিন ভিতরেও গিয়েছি, এক, কোণায় একটা ঘরের বাইরে দুইজন পুলিশ আর রাজাকার বসে আছে। ভিতরে কে আছে জিজ্ঞেস করেছিলাম সাহস করে, তখন আমাদের ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছে। অবিশ্যি কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেই আমরা বের করে ফেলেছি। ভিতরে শফিক ভাই আছেন। মনে হয় আগের থেকে ভাল আছেন, খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাকি একটু হাঁটতে পারেন। ভাল ভাল ওষুধ দেয়া হচ্ছে তাকে তাড়াতাড়ি ভাল করে নেয়ার জন্যে। দু’একদিনের মাঝেই তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে অত্যাচার করে খবর বের করার জন্যে। তারপর তাকে মেরে ফেলা হবে। অত্যাচার করার সময়েই নাকি সাধারণত মারা যায় আলাদা করে আর মারতে হয় না।
সব কিছু জেনেশুনে আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে থাকে। সেদিনও আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে আছে। একজনের মৃন খারাপ হলে অন্যদেরও মন খারাপ হয়ে যায়। তাই যখন আশরাফ বলল শফিক ভাই যদি যুদ্ধে মারা যেতেন সেটাই তাহলে বেশি। ভাল হত তখন আমাদের আরো বেশি মন খারাপ হয়ে গেল। ফজলুও তখন আরো বেশি মান খারাপ করা একটা কথা বলতে যাচ্ছিল রাশেদ তখন তাকে থামিয়ে বলল, শফিক ভাইকে উদ্ধার করে আনলে কেমন হয়?
আমরা বাকি তিনজন একবারে চমকে উঠলাম, বললাম, কি বললি?
শফিক ভাইকে উদ্ধার করে আনলে কেমন হয়?
উদ্ধার? উ-উ-উ— ফজলু কথা শেষ করতে পারে না।
হ্যাঁ। রাশেদ গলা নামিয়ে বলল, আজ কাল যে কোনদিন শফিক ভাইকে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। একবার ক্যাম্পে নিয়ে গেলে শেষ। উদ্ধার করার এখনই হচ্ছে সময়—
কিন্তু কিন্তু— আশরাফ তোতলাতে থাকে।
কিন্তু কি?
এত কি সোজা? পুলিশ রাজাকার পাহারা থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। শফিক ভাই হাঁটতে পারেন না, তাকে উদ্ধার করে আনবি মানে? উদ্ধার করে এনে রাখবি কোথায়?
রাশেদ ভুরু কুচকে বলল, আমার একটা প্ল্যান আছে। প্ল্যানটা আগে শোন, তারপর ভেবে দেখ। ভয়ংকর বিপদের প্ল্যান। কিন্তু কাজ করতে পারে। আমাদের চারজনকে নিয়ে প্ল্যান।
আমাদের চারজনকে নিয়ে?
হ্যাঁ। এই প্ল্যানটা কাজ করবে কি না সেটা নির্ভর করবে। দুইটা জিনিসের ওপর। এক: সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার জয় বাংলার লোক কি না। দুই একটা স্টেনগান।
স্টেনগান?
হ্যাঁ। দুই নম্বর জিনিসটা হয়ে গেছে।
মানে? আমি আবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বললি?
আমার কাছে একটা স্টেনগান আছে। মুক্তিবাহিনী আমাকে ব্যবহার করতে দেয় নাই, লুকিয়ে রাখতে দিয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় যদি দরকার পড়ে আমি ব্যবহার করব।
রাশেদ একটু থেমে বলল, এক নম্বর জিনিসটা নিয়ে সন্দেহ ছিল সেটাও এখন নাই। সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার সিরাজুল করিম পুরোপুরি জয় বাংলার মানুষ। ডাক্তার সাহেব হাসপাতালের লুকিয়ে গুলী-খাওয়া মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করেছেন। গতকাল পাকা খবর পেয়েছি।
কোথা থেকে খবর পেয়েছিস?
জিজ্ঞেস করিস না, তোদের জানার দরকার নাই।
আমাদের মনে পড়ল। যেটা জানার দরকার নেই, সেটা নিয়ে আর কৌতূহল
দেখানো ঠিক না।
আশরাফ বলল, প্ল্যানটা আগে বল। শুনে দেখি।
খুব ডেঞ্জারাস। আমরা মারা পড়তে পারি। আবার—
আবার কি?
অবস্থা জটিল হয়ে গেলে আমাদের স্টেনগানের গুলীতে একটা দুইটা রাজাকার মরতেও পারে। আমি অবশ্য সেটা চাই না।
আমরা মাথা নাড়লাম, আমরাও চাই না।
প্ল্যানটা আগে কল।
শোনা তাহলে, স্টেনগান ছাড়া লাগবে একটা ছোট কঁচি, কয়েকটা চিঠি আর একটা ব্যান্ডেজ।
আমি ভুরু কুচকে বললাম, চিঠি? ব্যান্ডেজ? কাঁচি? কি বলছিস?
শোন তাহলে— রাশেদ গলা নামিয়ে আমাদের পরিকল্পনাটা খুলে বলে আর শুনে আমরা একেবারে হা হয়ে যাই। রাশেদের মাথায় যে এত বুদ্ধি আমরা ঘূর্ণক্ষরেও সন্দেহ করি নি! বড় হলে সে আইনস্টাইন না হয় নাসিরুদ্দিন হোজ্জা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ফজলু তার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, ফার্স্ট ক্লাস।
কি মনে হয় কাজ করবে?
আশরাফ বলল, একশবার!
তাহলে এখন সবাই প্রতিজ্ঞা করি এটা কাউকে বলবি না।
আমরা একসাথে বললাম, কাউকে বলব না।
শুধু তাই নয় চারজন একসাথে হাতে হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম শফিক ভাইকে আমরা বাঁচাব। ফেভাবেই হোক।
১৬. সরকারী ডাক্তার সিরাজুল করিম
সরকারী ডাক্তার সিরাজুল করিমের বাসা হাসপাতালের সাথে লাগানো। তৈরি করা হয়েছে এভাবে, যেন হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে বাসা থেকে এক ছুটে হাসপাতালে চলে যেতে পারেন। তার বয়স বেশি না। একটু মোটা মতন, মাথার সামনে চুল পাতলা হয়ে আসছে। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আমরা পরদিন সকালে তার সাথে দেখা করতে গেলাম, পরিকল্পনার এটা হচ্ছে প্রথম কাজ। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল চারজনই যাব কিন্তু রাশেদ বলল যে শুধুমাত্র একজন যাব। গোপনীয়তার জন্যে চারজন একসাথে যেতে পারবে না। আমরা তখন ঠিক করলাম আশরাফ যাবে। সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। আশরাফ ব্লাজি হল না, গত বছর তার যখন চিকেন পক্স হয়েছিল ডাক্তার সিরাজুল করিম তাকে দেখেছিলেন, তাকে চিনে ফেলতে পারেন। তখন সবাই বলল আমাকে যেতে। আমি মোটেও চাচ্ছিলাম না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতে হবে। কাজেই আমি রাজি হলাম। কি বলতে হবে কিভাবে বলতে হবে