স্যার চলে যাবার সাথে সাথে ফজলু রাশেদের কাছে গিয়ে বলল, আমি কিন্তু তোকে রাশেদ-ফাসেদ ডাকতে পারব না। ওই সব নাম আমার মুখে আসে না।
আমিও মাথা নাড়লাম। বললাম, লাড়ডুই ভাল। তোর চেহারার মাঝেই একটা লাড্ডু লাড্ডু ভাব আছে। আমিও লাড্ডুই ডাকব।
রাশেদ দাঁত বের করে হেসে বলল, তোদের যা ইচ্ছা!
ক্লাস কেপ্টেন আশরাফ মৃদু স্বরে বলল, বলে দেব স্যারকে আমি। বলে দেব কিন্তু।
দে বলে, ফজলু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরে এল।
রাশেদের নিজের যখন লাড্ডু নামে আপত্তি নেই তখন ক্লাস কেপ্টেন স্যারকে বলে দিলেই কি আর না দিলেই কি ! তাছাড়া ক্লাস কেপ্টেন আশরাফ চোখ-মুখ লাল করে অনেক হস্পিবিতম্পিব করে ঠিকই কিন্তু কখনোও অন্য ক্লাস কেপ্টেনদের মত স্যারদের কাছে নালিশ করে না। আশরাফের মনটা ভাল আছে, একটা শুধু সমস্যা— পড়াশোনায় অতিরিক্ত ভাল। চোখ বন্ধ করে প্রত্যেক পৰীক্ষায় ফাস্ট হয়ে যায়। শুধু যে পরীক্ষায় ফাস্ট হয় তাই না, কথাও বলে শুদ্ধ ভাষায়, কাপড়ও পরে পরিস্কার, এমন কি চুল পর্যন্ত সব সময় আচড়ানো থাকে। দেখলেই বোঝা যায়, কেমন জানি ভাল ছেলে ভাল ছেলে।
রাশেদের অবিশ্যি সেরকম কোন সমস্যা নেই। মনে হয় আমাদের বন্ধু হয়ে যাবে বেশ তাড়াতাড়ি।
০২. রাশেদ যে মহা মিচকে শয়তান
রাশেদ যে মহা মিচকে শয়তান সেটা আমরা বেশ তাড়াতাড়ি আবিস্কার করলাম। তাকে আমার লাড্ডু বলেই ডাকব ঠিক করেছি, সেও কোন আপত্তি করেনি। কিন্তু আসলেই যখন তাকে লাড্ডু বলে ডাকি ব্যাটা কোন উত্তর দেয় না, ভান করে থাকে যেন শুনতে পায়নি। যতক্ষণ রাশেদ বলে না ডাকছি। সে না শোনার ভান করে উদাসমুখে বসে থাকে। রাশেদ বলে ডাকামাত্র মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে, আমাকে ডাকছিস? ব্যাটার ন্যাকামো দেখে মরে যাই !
আমি আর ফজলু খুব রেগে—মেগে ঠিক করলাম, যত চেষ্টাই করুক আমরা তাকে লাড্ডু বলেই ডেকে যাব, কিছুতেই রাশেদ ডাকব না। কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই আমরা দুজনেই বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, সবার সাথে সাথে আমি আর ফজলুও তাকে রাশেদ বলে ডাকছি।
শেষ পর্যন্ত আমরাও হাল ছেড়ে দিলাম। রাশেদ হাসান নামটা তার সত্যিই পছন্দ, এই নামে ডাকলে সে যখন এত খুশি হয়, না হয় ডাকলামই তার নতুন নাম দিয়ে।
কয়দিনের মাঝে আমরা টের পেলাম, রাশেদ ছেলেটা আর দশটা ছেলের মত না। সে মোটেও বেশি কথা বলে না, কিন্তু তাই বলে বোকা না। সে ঘোষণা করেছে, পর পর দুই বছর ফেল করে পড়াশোনার ঝামেলা চুকিয়ে দেবে, কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হবে বলে মনে হয় না। অন্য কোন সাবজেক্টে ঝামেলা না হলেও মনে হয় ইংরেজিতে পােশ করে যাবে। এইটুকু ছেলে এরকম কঠিন ইংরেজি শিখল কি করে সেটা প্রথম প্রথম আমাদের কাছে একটা রহস্য ছিল। সাধারণত আমাদের মাঝে যারা বড় লোকের ভদ্রঘরের ছেলে তারা ইংরেজি কমিক টমিক পড়ে ভােল ইংরেজি শিখে। রাশেদকে দেখে মনে হয় না সেরকম ছেলে, তার বাবা কাঠমিস্ত্রী না হয় ইলেকট্রিশিয়ান, মোটেও ইংরেজি-জােনা বড়লোক না। রাশেদ নিজেই একদিন কারণটা বলল— তার বাবা ইংরেজি জানে না বলে মাঝেমাঝেই ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ে তাকে বোঝাতে হয়। একটা ডিকশনারি নিয়ে বসে বানান করে পড়তে পড়তে সে ইংরেজি শিখে গেছে। আজকাল সে চোখ বুজে। ‘বাক স্বাধীনতা’ বা ‘অর্থনৈতিক শোষণ’ এরকম কঠিন কঠিন জিনিস ইংরেজিতে বলে ফেলতে পারে।
রাশেদের আরো কিছু অবাক ব্যাপার আছে। তাকে যা ইচ্ছা তাই বলা যায়, সে কিছুতেই রাগ হয় না। সে প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনই ফজলু তাকে নিয়ে কবিতা বানাল—
আব্বুকা লাড্ডু
পরীক্ষায় গাড্ডু,
একদম ফাড্ডু
সাংঘাতিক কবিতা সেরকম কলা যায় না। কিন্তু যার নাম লাড্ডু তার কানের কাছে যদি এই কবিতা তিবিশি সেকেন্ড পর পর বলা হয়, তার মেজাজ খারাপ হবার কথা। কিন্তু রাশেদের বেলায় সেটা সত্যি হল না। প্রত্যেকবার ফজলু এই কবিতাটি বলল আর রাশেদ শুনে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল, যেন এর থেকে মজার আর কোন ব্যাপার পৃথিবীতে থাকতে পারে না। ফজলু এক সকালে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। একজন মানুষ যদি না রাগে তাকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে সময় নষ্ট করে কি লাভ?
রাশেদকে যা খুশি বলা যায়। কিন্তু তার গায়ে হাত দেয়া যায় না। ফাজিলেমি করে একটু-আধটু সে সহ্য করে কিন্তু রাগারগি করে তাকে একটা ধাক্কা দিলেও সে ঘুরে এসে ডবল জোরে ধাক্কা দিয়ে তার উত্তর দেয়। আমাদের সাথে তো করেই— একদিন কান্দেরের সাথে করে ফেলল। কাদের হচ্ছে আমাদের ক্লাস-গুণ্ডা। ফেল করে করে আমাদের ক্লাসে এসেছে। তার মনে হয় এখন কলেজে-টলেজে পড়ার কথা। সে হচ্ছে আমাদের ক্লাসের একমাত্র ছেলে যে গঙ্গা নাপিতের দোকানে দাড়ি কামিয়ে আসে। শুধু যে দাড়ি কামায় তাই নয়, বগলও কামিয়ে আসে। আমরা কখনো কাদেরকে ঘাটাই না, মাঝে মাঝে সে পিছন থেকে আমাদের মাথায় চাটি মেরে কিছু একটা গলাগলি দেয়, আমরা চুপ করে সহ্য করে যাই। একদিন খামােখা সে রাশেদের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই ফাডুর বাচ্চা, কিলিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলব।
রাশেদ সাথে সাথে কাদেরকে গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, আমার নাম ফাড্ডু না।
কাদের চিন্তাও করতে পারেনি এই ক্লাসে কেউ তার গায়ে হাত দেবে, সে মোটেও এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়ে তাল হারিয়ে একটা বেঞ্চিতে লেগে একেবারে হুড়মুড় করে আছড়ে খেয়ে পড়ল। কয়েক মুহুর্ত লাগল তার বুঝতে কি হচ্ছে। যখন বুঝতে পারল তখন রাগে ক্ষ্যাপা শুওরের মত চোখ লাল করে ওঠে এল। রাশেদকে একেবারে ছিড়েই ফেলত। কিন্তু ঠিক তখন অংক স্যার এসে গেলেন বলে কিছু করতে পারল না।