আমি চমকে উঠে মাথা নিচু করলাম। সর্বনাশ হয়েছে, ধরা পড়ে গেছি।
কোথায় ছিলি?
আমি চুপ করে রইলাম। অরু আপা ধমকে উঠলেন, কোথায় ছিলি?
অরু, আপা আমি তোমাকে বলতে পারব না।
তোকে বলতেই হবে, অরু আপা হিংস্র গলায় বললেন, না হলে তোকে আমি খুন করে ফেলব। খুন করে ফেলব।
অরু আপকে দেখে মনে হল সত্যি আমাকে খুন করে ফেলবেন। আমি কোন রকমে বললাম, অরু, আপ
তুই জানিস সারারাত আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? সারারাত। তুই জানিস? জানিস?
অরু আপা —
তোর বাসার সবাই জানে তুই এখানে। আমি জানি তুই পালিয়ে গেছিস বাড়ি থেকে। কোথায় ছিলি? কোথায় ছিলি কাল রাতে?
অরু আপা, আমি বলতে পারব না।
বলতেই হবে তোকে। অরু, আপা আমার হাতে ধরে এত জোরে চাপ দিলেন যে ব্যাথায় চোখের পানি এসে গেল। ভয়ংকর চেহার করে বললেন, এখন আমাকে বলতেই হবে। বলতেই হবে–
অরুণ অপা—
বলতেই হবে তোর। বলতেই হবে। কোথায় ছিলি কাল রাতে?
অরু, আপা আমি বলতে পারব না।
অরু আপা আমাকে ছেড়ে দিলেন। বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, যা। তুই আর কোনদিন আমার কাছে আসবি না। কোন দিন না। যা। বের হয়ে যা।
অরু আপা কখনো আমার সাথে এত কঠিন গলায় কথা বলেননি, আমার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। কিন্তু আমি তো কিছুতেই অরু আপাকে সত্যি কথাটি বলতে পারব না। আসার আগে আমি আর রাশেদ কাজল ভাইয়ের গা ছুয়ে দেশের নামে প্রতিজ্ঞা করে এসেছি। আমি মাথা নিচু করে চেষ্টা করতে লাগলাম চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে। অরু আপা দরজা খুলে বললেন, যা বের হয়ে যা। এই মুহুর্তে বের হয়ে যা।
আমি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে অরু, আপার হাতে দিলাম। অরু, আপা জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা?
তোমার চিঠি। শফিক ভাই দিয়েছে।
শফিক? অরু, আপা চমকে উঠে বললেন, শফিক ফিরে এসেছে। দেখা হয়েছে তোর সাথে?
তোমাকে বলতে পারব না। অরু আপা। আমরা দেশের নামে প্ৰতিজ্ঞা করেছি—
তুই– তুই মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেছিস?
আমি মাথা নিচু করে রইলাম।
অরু আপা নিচু হয়ে আমার কাছে এসে হঠাৎ আমাকে বুকে চপে ধরে ভাঙা গলায় বললেন, এইটুকন ছেলে তুই, এখন তোর ঘুড়ি ওড়ানোর কথা, মাঠে বল খেলার কথা, আর তুই কি না মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করিস? নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে?
তুই? তোর মত বাচ্চা ছেলে? তোর মত বাচ্চা ছেলে?
তারপর হঠাৎ কথা নেই বাৰ্ত্তা নেই। অরু আপা আমাকে শক্ত করে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
অরু, আপা যদিও টের পেয়েছিলেন। আমি বাসা থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও রাত কাটিয়ে এসেছি। তিনি কাউকে সেটা বলেন নি। আম্মা আব্বা তাই জানতে পারলেন না কিছু। আমি অবিশ্যি খুব সাবধানে থাকলাম সারাদিন, ভুল করে যদি বলে ফেলি, কাল রাতে মশার কামড় খেয়ে- তাহলেই হয়েছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি বলে দুপুরে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কষ্ট করে জেগে রইলাম। সারাদিন।
পরদিন সকালে আমি অভ্যাসমত আমাদের দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসেছি। আব্বা একটু আগে গেছেন। মিলিটারী ঘোষণা দিয়েছে কলেজ খোলা রাখতে। কলেজে কোন ছাত্র নেই। তবু আব্বাকে গিয়ে কলেজে বসে থাকতে হয়। আব্বা প্রত্যেকদিন কলেজে যান খুব মন খারাপ করে। ফিরে আসেন আরো বেশি খারাপ করে। মনে হয় আব্বা কয়দিনের মাঝে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাবেন। কোথায় যাবেন এখনো জানি না, মনে হয় দেশের বাড়িতে। রাস্তাঘাট এখনো নিরাপদ নয়, সেটাই সমস্যা।
আমি দেওয়ালে পা বুলিয়ে বসে থেকে একটু পরেই বুঝতে পারলাম আজ বুধবার। প্রতি বুধবারে আগে এখানে অনেক বড় বাজার বসত। আশে-পাশের সব এলাকা থেকে নানারকম সওদা নিয়ে লোকজন আসত। বুধবারে বাজারে পাওয়া যেতে না সেরকম জিনিস নেই। মিলিটারী আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত কয়েক সপ্তাহ থেকে মনে হচ্ছে সেটা আবার আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। আগের মত এত বড় নয়। কিন্তু ছোটখাট একটা বাজার বসছে। আমি দেখলাম লোকজন হাঁস, মুরগী, শাকসবজী, ডালা কুলো নিয়ে আসছে। মাথায় ফলমূলের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে। জুন মাস, এই সকালেই কি সাংঘাতিক গরম। একজন মানুষকে দেখলাম মাথায় একটা ঝাকায় করে কলা নিয়ে যাচ্ছে, ঘামছে দীর দর করে। আমার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা চোখ সরিয়ে নিল আর আমি হঠাৎ করে চিনে ফেললাম তাকে। কাজল ভাইদের দলে দেখেছি তাকে, একসাথে বসে গুড দিয়ে চা খেয়েছি। আমরা আগের রাতে। মাথায় কলার ঝাকায় শুধু কলা নেই, নিচে নিশ্চয়ই অস্ত্রশস্ত্র। তার মানে মুক্তিবাহিনী মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসছে। উত্তেজনায় আমার বুক ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করতে থাকে। কখন আক্রমণ করবে? আজ রাতে? একবার ভাবলাম লোকটার পিছু পিছু যাই, দেখি কি করে, কোথায় যায়। কিন্তু গোলাম না, আমাকে যখন না চেনার ভান করেছে। আমারও না। চেনার ভান করতে হবে।
আমি ছটফট করেত থাকি। রাশেদ যদি আসত তার সাথে কথা বলা যেতো। আজ রাতেই নিশ্চয়ই আক্রমণ হবে। শফিক ভাই কি এসে গেছেন? কাদের? কোথায় আছে কে? নূর মোহাম্মদ বেকারীতে? আমি দেওয়াল থেকে লাফিয়ে নোমলাম ঠিক তখন দেখলাম রাশেদ হেঁটে হেঁটে আসছে। রাশেদের মুখ গন্তীর। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, রাশেদ জানিস আজ রাতে। —
রাশেদ ঠোঁটে আংগুল দিয়ে বলল, শ-স—স—স, আস্তে।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, আজ রাতে ক্যাম্পে অপারেশন হবে।
রাশেদ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তুই কেমন করে জানিস?