কেন?
নাসায় জানে না।
জানে না? চশমা পরা মানুষটা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, যাই হোক যা হবার হয়েছে। আমাকে তোমরা কাজল ভাই বলে ডাকতে পার।
কাজল ভাই?
হ্যাঁ। আমার আসল নাম কিন্তু কাজল না। আমরা একটা স্পেশাল মিশনে এসেছি, আসল নাম বলা নিষেধ। কাজল নামটা আমার খুব পছন্দ। তাই এখন আমার নাম কাজল ভাই।
গোফওয়ালা একজন তার গোফ টানতে টানতে বলল, আমার মাঝে মাঝে মানে থাকে না, তখন কাজল না ডেকে সুরমা ডেকে ফেলি।
কাজল ভাই হো হো করে হেসে বললেন, ধুর। সুরমা তো মেয়েদের নাম।
আরেকজন হঠাৎ মাথা নেড়ে গান গেয়ে উঠল, চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কি হবে . . .
সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠে। কাজল ভাই ঘড়ি দেখে বললেন, দুই নম্পর্বর দলটা তো এখনো এল না। ওদের জন্যে অপেক্ষা করব না কি শুরু করে দেব?
কালোমতন একজন তার গোফ টানতে টানতে বলল, নদীতে গান বোটের বড় উৎপাত, অনেক সময় লাগে পার হতে। তার ওপর বড় রাস্তায় মিলিটারী পাহারা দিচ্ছে সোজাসুজি আর আসা যায় না। দুনিয়া ঘুরে ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়।
ফর্সা মতন একজন বলল, গুলীর বাক্স মাথায় নিয়ে।
গ্রামের লোকজন অবশ্য সাহায্য করে।
তা করে। না হলে উপায় ছিল?
কাজল ভাই বললেন, আমরা তাহলে ওদের ছাড়াই শুরু করে দেই।
হ্যাঁ, শুরু করেন।
কাজল ভাই পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে সামনে রেখে হারিক্যানটা উসকে দিলেন। আমরা মাথা উঁচু করে দেখলাম আমাদের আঁকা স্কুলের ম্যাপিটা। রাশেদ চোখ বড় বড় করে বলল, আমাদের ম্যাপ।
হ্যাঁ, কাজল ভাই এক গাল হেসে বললেন, এখন বলা যায় সোনার খনি।
কাজল ভাই ম্যাপিটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এটা কি শ্ৰেদ্ধকাল মত আঁকা হয়েছে। এক ইঞ্চি সমান দশ গজ। এইটা কি সত্যি?
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, আশরাফ গ্রাফ পেপারে ঐকেছিল, হেঁটে হেঁটে মেপেছে সবকিছু।
ভেরি গুড। কাজল ভাই খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এই যে লাইব্রেরির ঘর স্কুল থেকে একটু আলাদা, এখানে লিখেছ মূল অস্ত্রাগার। এটা কি সত্যি?
রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, সত্যি।
কেমন করে জান?
আমি দেখেছি।
কি দেখেছ?
দেখেছি মিলিটারীগুলি অপারেশন শেষ করে এসে সব অস্ত্র এখানে জমা দেয়। গুলীর বাক্সগুলি এনে এখানে রাখে।
সব সময় কয়জন পাহারা থাকে। এখানে। যারা মাথায় গুলীর বাক্স নিয়ে গেছে তারা বলেছে ভিতরে নাকি শুধু মেশিন গান আর মেশিন গান।
কাজল ভাই লাল পেন্সিল দিয়ে লাইব্রেরিটা ঘিরে একটা দাগ দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এর দরজা কোন দিকে?
আমরা দেখিয়ে দিলাম, এদিকে আছে। ওদিকেও আছে।
ফর্সা মতন ছেলেটা জিব দিয়ে চুকচুক করে বলল, এদিকে হলে ভাল হত।
কাজল ভাই বললেন, হ্যাঁ। তবে এটা বড় সমস্যা না।
সবাই পুকুরটা নিয়ে খানিকক্ষণ কথা বলল, কাজল ভাই এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বলতে পারবে এই পুকুরের ঢালুতে যদি কেউ শুয়ে থাকে তাহলে কি স্কুলের দোতলা থেকে দেখা যায়?
না। আমি আর রাশেদ একসাথে মাথা নাড়লাম।
কেমন করে জান?
আমরা লুকোচুরি খেলার সময় মাঝে মাঝে এখানে লুকাই, তখন দেখেছি।
তার মনে পুকুরের ঢালুতে কেউ থাকলে ছাদে যে ব্যাংকার করেছে সেখান থেকে দেখা যাবে না?
না।
গুড। কাজল ভাই খুশি খুশি মুখে পুকুরকে ঘিরে কয়েকটা ক্রস ঐকে বললেন, গুড এখান থেকে কভার দিলে পুরোটা নিরাপদ।। দুইটা এস. এম. জি. হলেই পুরোটা কভার হয়।
সবাই মাথা নাড়ল।
গোঁফওয়ালা ছেলেটা বলল, এই পুরো জায়গার মধ্যে সমস্যা হচ্ছে এই বাংকার। মর্টার দিয়ে চেষ্টা করা যায় না?
না। কাজল ভাই মাথা নাড়লেন, কাছে বাড়িঘর দোকানপাট। পাবলিক মারা পড়বে।
রাশেদ বললেন, ছাদের বাংকারে মিলিটারী থাকে না। শুধু দরকারের সময় উঠে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি। মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করে তখন দৌড়ে গিয়ে ছাদে উঠে। তা ছাড়া এখন বর্ষার সময়, বাংকারে ভাল ছাদ নাই, কেউ থাকে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, তা ছাড়া মিলিটারীরা জোককে খুব ভয় পায়। বর্ষার সময় এই দিকে অনেক জোক। আর—
আর কি?
আমাদের স্কুলের দোতলা এখানে শেষ হয় নাই। সিঁড়িটা খোলা, এই দিক দিয়ে গেছে। রাশেদ ম্যাপে হাত দিয়ে সিঁড়িটা দেখিয়ে বলল, এই সিঁড়ি দিয়ে বাংকারে যেতে श्।
কাজল ভাই ভুরু কুচকে রাশেদের দিকে তাকালেন। রাশেদ বলল, রাস্তার এই পাশে কেউ যদি একটা স্টেনগান না হয় মেশিন গান নিয়ে বসে থাকে, যদি সিঁড়ির দিকে গুলী করতে থাকে তাহলে কেউ সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যেতে পারবে না।
কাজল ভাই একটু অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রাস্তার এই পাশে কি আছে?
নূর মোহাম্মদের বেকারী। রুটি তৈরি করে। এই পাশে উত্তম লক্ট্রী। এইখানে আরেকটা চায়ের দোকান।
এটা ইটের দালান?
হ্যাঁ।
তুমি শিওর?
শিউর।
এখান থেকে সিঁড়িটা কভার করা যাবে?
যাবে।
কাজল ভাই এবং অন্যেরা ম্যাপিটার দিকে তাকিয়ে নানারকম কথা বলতে শুরু করলেন কি একটা ব্যাপার নিয়ে দুজনের খানিকক্ষণ তর্কও হল। কাজল ভাই একসময় সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মনে হয় এই লোকেশানটা একটা এটাকের জন্যে খুব ভাল। খুব সুন্দর পজিশন দেওয়া যাবে। আমার ইচ্ছা অস্ত্রাগার থেকে কয়টা রকেট লঞ্চার নেওয়া। খুব অভাব রকেট লঞ্চারের। যদি নেওয়া না যায় ঘরটা উড়িয়ে দেওয়াও খারাপ না।