কর।
আমি তো ছোট, কিন্তু এমন যদি হয় যে আমার উপর একটা দায়িত্ব আছে যেটা বড়দের দায়িত্ব কিন্তু যেটা শুধু আমি করতে পারি— আমি এবং আমার মত আরো কেউ— মানে— ইয়ে
অরু আপা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন অ্যর হঠাৎ করে আমার মুখে কথা জড়িয়ে গেল। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম, অরু আপা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বলছিস? দায়িত্ব? কি দায়িত্ব?
না মানে ইয়ে–
বল কি বলছিস্? খুলে বল।
না কিছু না। আমি চুপ করে গেলাম।
অরু আপা ভুরু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার মনটা খুঁৎ খুঁৎ করতে শুরু করল। পুরো পরিকল্পনাটা কেমন সুন্দর কবে গুছিয়ে এনেছিলাম এখন মনে হচ্ছে ভেস্তে যাবে। বোকার মত একটা কথা বলে কি ঝামেলা করে ফেললাম। অরু আপা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, শোন, যদি ভেবে থাকিস তুই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করবি– সেটা ভুলে যা। সেটার চেষ্টা করে শুধু নিজেদের বিপদে ফেলবি না। যারা সত্যিকার মুক্তিবাহিনী তাদেরকেও বিপদে ফেলবি। তেরা এখন বাচ্চা- একেবারে বাচ্চা।
আমি প্রবল বেগে মাথা নাড়লাম, না না। আমি মুক্তিবাহিনীতে যাবার কথা বলছি না।
হ্যাঁ! বলিস না। একদিন দেশ স্বাধীন হবে তখন দেশের জন্যে কাজ করার অনেক সুযোগ পাবি।
আমি মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ পাব।
মন দিয়ে পড়াশোনা করি। ট্রানশ্রেশান কর, দেশের কাজ হবে। কোন রকম পাগলামী করিস না।
না করব না।
অরু আপা বাসা থেকে বের হয়ে আসি খুব সাবধানে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম।
১০. রাত বেশি হয় নি
রাত বেশি হয় নি, মাত্র আটটা বাজে। কিন্তু এর মাঝে কি অন্ধকার। আমি আর রাশেদ সেই অন্ধকারেই গুটিগুটি হেঁটে যাচ্ছি। বাজারের কাছে এসে খানিকক্ষণ একটা দোকানের পাশে লুকিয়ে থাকতে হল, কয়েকটা রাজাকার যাচ্ছিল কথা বলতে বলতে। নদীর কাছে এসে আমাদের মাঠে নেমে যেতে হল, বড় বীজটার দুই পাশে এখন মিলিটারী পাহারা। রাত্ৰিবেলা কেউ এখন ব্রীজটা পার হতে পারে না। দিনের বেলাতেই মিলিটারীরা দাঁড় করিয়ে হাজার রকম প্রশ্ন করে একটু সন্দেহ হলেই নদীর তীরে নিয়ে গুলী করে মেরে পেলে। লোকজন কেউ এখন আর বীজ দিয়ে পার হয় না নৌকা করে পার হয়।
রাশেদ মনে হয় এলাকাটা বেশ ভাল করে চিনে। মাইলখিানেক অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে এক জায়গায় এল, নদীতে অনেকগুলি নৌকা সেখানে কাছাকাছি রাখা। রাশেদ এদিক সেদিক তাকিয়ে চাপা গলায় ডাকল, হানিফ ভাই –
কে?
আমি রাশেদ।
এই যে এদিকে।
আমরা হাতড়ে হাতড়ে নৌকাটাতে উঠে পড়ি। নৌকার মাঝি বলল, আর কেউ কি আসবে?
হানিফ নামের মানুষটা বলল, না। চল ও পাড়ে।
মাঝি লাগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা ছেড়ে দিল। হানিফ নামের মানুষটা বলল, তোমার সাথে কে?
আমার বন্ধু ইবু। আপনাকে বলেছিলাম, মনে নাই?
ও।
হানিফ মানুষটা মনে হয় বেশি কথা বলতে পছন্দ করে না। নৌকায় বসে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল, ওমনা মনারে আমার ছাইড়া তুমি কই গেলা রে . . .
গলায় সুর নেই। আর গানের কথাগুলিরও কোন অর্থ নেই। কিন্তু হানিফ আপন মনে গান গেয়ে যেতে থাকল। অন্ধকারে, নদীর ঠাণ্ড বাতাসে, নৌকার দুলুনীতে একটু পর গানটা আমার বেশ ভালই লাগতে থাকে।
আমি গলা নামিয়ে রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কি মুক্তিবাহিনী?
না, মুক্তিবাহিনীর লোক।
ও।
নদীর ওপাড়ে নেমে আমরা আবার হেঁটে যেতে থাকি। অনেক দূর হেঁটে আমরা গাছপালা ঢাকা একটা ছোট বাড়িতে হাজির হলাম। রাস্তায় একটা কুকুর ঘেউঘেউ করতে থাকে আর একজন মানুষ রাগ-রাগ গলায় জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি হানিফ।
কোন হানিফ?
রাশেদ আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, গোপন পাশওয়ার্ড।
অন্ধকার থেকে মানুষটা এবারে বের হয়ে এল, হাতে আলগোছে একটা রাইফেল ঝুলিয়ে রেখেছে। বলল, আস ভিতরে। সাথে এই বাচ্চা কারা?
যার কথা বলেছিলাম।
একেবারে বাচ্চা ছেলে দেখি!
ভিতরে একটা হারিকান জ্বলিয়ে বেশ কিছু মানুষ বাসে আছে। কয়েকজন তাস খেলছে। বিছানায় বসে। হারিক্যানের অল্প আলোয় চকচক করছে কয়েকটা স্টেনগান।
চশমা পরা একজন বলল, হানিফ কি খবর তোমার।
ভাল। মিলিটারী ক্যাম্পের ম্যাপ যারা তৈরি করেছে তাদের নিয়ে এসেছি।
আরে! এ দেখি দুধের বাচ্চা! চশমা পরা মানুষটা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কাছে আসি, কাছে আস।
আমরা কাছে গেলাম, চশমা পরা একজন মানুষ আমাদের মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ম্যাপ দেখে আমি ভেবেছিলাম তোমরা আরো বড় হবে। ফার্স্ট ক্লাস একটা ম্যাপ। এত সুন্দর ম্যাপ তৈরি করা শিখলে কেমন করে?
রাশেদ বলল, শিখি নাই! আন্দাজে আন্দাজে করেছি। আমি বললাম, আমরা যখন গুপ্তধন খেলতাম তখন ম্যাপটা তৈরি করেছিলাম। আমাদের সাথে আশরাফ নামের একজন আছে সে বিল্ডিংগুলি, ক্লাশ ঘর, পুকুর, গাছ এই সব এঁকেছে।
আর মিলিটারী ক্যাম্পে এখন কোনটা কি—
সেগুলো রাশেদ করেছে।
চশমা পরা মানুষটা আবার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল আস্তে আস্তে বলল, সাংঘাতিক একটা কাজ করেছ তোমরা। সাংঘাতিক কাজ! কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তোমরা আরো বড় হবে। স্কুলে নাইন টেনে পড়ে এরকম বেশ বড় বড় ছেলে আছে তো সেরকম। কিন্তু তোমার এত ছোট জানলে কিছুতেই আসতে বলতাম না। কিছুতেই না। তোমাদের বাসায় চিন্তা করবে না?
আমি ইতস্ততঃ করে মাথা নাড়লাম, না।