আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুই রাজনৈতিক আলোচনা বুঝিস?
বুঝব না কেন? না বোঝার কি আছে!
আমরা সবাই আবার ভাল কর ছেলেটাকে দেখলাম। মাথায় লালচে এলোমেলো চুল, শার্টের সবগুলি বোতাম নেই, একটি সিফটিপিন দিয়ে আঁটকানো। নীল রংয়ের প্যান্ট, খালি পা। শ্যামলা রং, ভাবুক চোখ। দেখে যে কেউ ভাববে সাধারণ একটা ছেলে, কিন্তু সে মোটেও সাধারণ না। তার মা নেই, বাবা তার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে। শুধু তাই নয়, তার কোন ভাল নাম নেই– আমার কেউ স্বীকার করলাম না। কিন্তু আমাদের সবার ভিতরে একটা হিংসার জন্ম হল।
পরদিন আমরা সবাই একটা করে নাম লিখে এনেছি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর মজিদ স্যার ভাল এবং সুন্দর নামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা বড় লেকচার দিলেন। স্যার লেকচার দিতে বড় ভালবাসেন। তারপর ছেলেটাকে ডেকে সামনে দাঁড়া করলেন, তাকে নিয়ে এত বড় একটা ব্যাপারে মনে হল সে একটু লজ্জা পাচ্ছিল। স্যার বললেন, এখন তোরা। একজন একজন করে নামটা পড়বি। তখন অন্য সবাই সেই নামে ভোট দিধি। যে নামে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়বে সেই নামটা দেয়া হবে।
আমরা তখন একে একে নাম পড়তে শুরু করলাম, অন্য সবাই হাত তুলে ভোট দিতে লাগল, এবং আশরাফ একটা কাগজে নাম এবং ভোটের সংখ্যা লিখে রাখতে লাগল। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বোঝা গেল নাম দেওয়ার এই পদ্ধতিটি কাজ করার সম্ভাবনা কম। তার কারণ সবচেয়ে বেশি ভোট পেল যে দুটি নাম তার একটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুৰ, অন্যটি কাজী নজরুল ইসলাম। স্যারকে তখন নতুন আইন জারি করতে হল যে, কোন বিখ্যাত মানুষের নাম দেয়া যাবে না। তখন যে নামটি বেশি ভোট পেয়ে গেল সেটা হচ্ছে রবার্ট ব্ৰাউন। তখন স্যারকে আবার নতুন আইন জারি করতে হল— বিদেশী নাম দেওয়া যাবে না। ফজলু সব সময় একটু গোয়ার গোছের, বিদেশী নাম দেয়া হলে ক্ষতি কি সে এটা নিয়ে স্যারের সাথে একটা তর্ক শুরু করে দিলে! শুধু তাই নয়, লাড্ডু নামের ছেলেটাও লাজুক মুখে জানােল তার বিদেশী নামে কোন আপত্তি নেই !
স্যার তখন কেন দেশী নাম হতে হবে সেটা বোঝানোর জন্যে দেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এই সব বড় বড় জিনিস নিয়ে একটা লেকচার দিয়ে ফেললেন, স্যার লেকচার দিতে বড় ভালবাসেন। লেকচার শেষ করে বললেন, এখন তোদের আর ভোট দিতে হবে না, নামগুলি পড়, আমার যেটা ভাল লাগবে সেটাই আমি বেছে নেব।
আমরা সবাই লিখে আন নামগুলি বললাম, স্যার যেগুলি পছন্দ হল সেগুলি একটা কাগজে লিখে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। প্রথম নামটি আলী জাকারিয়া।
স্যার খানিকক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, উন্থ। জাকারিয়া নাম হতে হলে মুখ একটু লম্বা হতে হয়। তোর মুখ গোল। তোকে এই নামে মানাবে না।
দুই নম্বর নামটি বের হল— কায়সার আহমেদ। স্যার আবার মাথা নাড়লেন, বললেন, কায়সারদের চুল কোকড়া হতে হয়। তোর চুল কোকড়া নয়। চুল আচড়াস না। বলে পাখির বাসার মত হয়ে আছে কিন্তু তোর চুল কোকড়া না। এই নাম চলবে না।
পরের নামটি বের হল হাসান ফেরদৌস। স্যারের নামটা কেশ পছন্দ হল, প্ৰায় দিয়েই দিচ্ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত পাল্টালেন, বললেন, ফেরদৌস নামটার জন্যে গায়ের রং ফর্সা হতে হয়।
আমাদের ক্লাসে আরেকজন ফেরদৌস আলী আছে। তার গায়ের রং কুচকুচে কাল কিন্তু তবু স্যার রাজি হলেন না। পরের নামটি পড়লেন? রাশেদ হাসান।
এই নামটা স্যারের খুব পছন্দ হল। কয়েকবার নানারকম গলার স্বর করে নামটা পড়লেন, তারপর বললেন, এই নামটা ভাল। নামের মাঝে একটা চরিত্র আছে, কি बनिन?
নামের আবার চরিত্র হয় কি করে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না, সবাই মাথা নাড়লাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কে দিয়েছে এই নাম? আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক ছেলে রঞ্জ উঠে দাঁড়াল। স্যার বললেন, ভেরী গুড নেমা ! কোথায় পেলি এই নাম?
রঞ্জু শোনা যায় না। এরকম গলায় বলল, আমার ছোট মামা এই নাম দিয়ে কবিতা লেখেন।…
ছদ্মনাম এটা?
জ্বী।
আসল নাম কি?
গজনফর মিয়া।
স্যার মাথা নাড়লেন, বললেন, কবি গজনফর মিয়া থেকে কবি রাশেদ হাসান অনেক ভাল শোনায়। তোর মামা ঠিকই করেছে। নে, বস।
রঞ্জ তাড়াতাড়ি বসে পড়ল। মজিদ স্যার এবারে ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন। সে কাছে এসে দাঁড়ালে স্যার দাড়িয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আজ উনিশ শ সত্ত্বর সালের সেপ্টেম্বর মাসের এগারো তারিখ আমি মজিদ সরকার, ক্লাস সেভেন সেকশন বি-এর ক্লাশ টিচার সবার পছন্দ থেকে বেছে তোর নাম দিলাম রাশেদ হাসান।
আমাদের কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু সবাই তখন একসাথে চিৎকার করে আনন্দের মত একটা শব্দ করলাম। স্যার তখন আরো খুশি হয়ে উঠলেন, মাথা নেড়ে বললেন, এখন আমি তোকে ডাকব, তুই জবাব দিবি, ঠিক আছে?
ছেলেটা মাথা নাড়ল। স্যার ডাকলেন, রাশেদ হাসান।
জ্বী।
ভেরী গুড। স্যার এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি তোবা। আর কেউ কোনদিন রাশেদ হাসানকে লাড্ডু বলে ডাকিস তোদের মাথা ভেঙে ফেলব। এখন থেকে এর নাম রাশেদ।
ফজলু দুর্বলভাবে একটু চেষ্টা করল, কিন্তু স্যার তার এতদিনের নাম—
হোক এতদিনের নাম। আজ থেকে রাশেদ। নতুন একটা নাম দেয়া হয়েছে, সেটা পাকা হবে না? কেউ লাড্ডু ডাকবি না, ঠিক আছে?
আমরা খুব অনিচ্ছার সাথে মাথা নাড়লাম।