আমি মাথা নাড়লাম, তা ঠিক।
উত্তেজনায় আমার বড় বড় নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন করে দেখা করব? কবে দেখা করব?
আজ রাতে।
আজ রাতে? আকাশ থেকে পড়লাম, আজ রাতে কেমন কের দেখা করব।
রাশেদ মাথা নাড়ল, তাই বলেছে, সময় নাই হাতে। আমি যাব দেখা করতে। তুই যেতে চাস?
আমি? আজ রাতে?
হ্যাঁ।
কেমন করে যাব? বাসায় কি বলব?
সেটা জানি না। কোন একটা মিছে কথা বলে —
কি মিছে কথা বলব? আমি খানিকক্ষণ বসে চিন্তা করি, সত্যিকার একটা মুক্তিবাহিনীর দলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার এমন একটা সুযোগ কেমন করে ছেড়ে দিই?
রাশেদ বলল, তোর আম্মাকে বল আজ রাতে আমাদের বাসায় থাকিবি। তুই যদি চাস আমি গিয়ে বলতে পারি।
আমি মাথা নড়িলাম, উহু তুই বললে কোন লাভ হবে না। তোর আব্বা না হয় আম্মা বললে একটা কথা ছিল। তা ছাড়া এখন এই মিলিটারী চারিদিকে, প্রতি রাতে দশটার পর কারফিউ, আম্মা রাতে কোথাও যেতে দেবে না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার অরু, আপার কথা মনে পড়ল। আমি রাশেদের দিকে তাকলাম, তবে
তবে কি?
অরু, আপাকে দিয়ে হতে পারে।
অক্স আপা?
হ্যাঁ— আমি ভুরু কুচকে চিন্তা করতে থাকি। একটা ফন্দী করা যায়, ধরা পড়লে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে, আব্বা মনে হয় একেবারে জানে মেরে ফেলবেন। কিন্তু দেশের জন্যে এইটুকু যদি না করি তাহলে কেমন করে হয়? রাশেদকে বললাম, তুই বিকালে এসে একবার খোঁজ নিবি? আমি দেখি একটা কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না।
রাশেদ চলে গেল। আমি আমার ফন্দীটিা কাজে লাগানোর জন্যে গেলাম অরু আপার বাসায়। অরু, আপা কানে রেডিও লাগিয়ে খবর শুনছিলেন। আমাকে দেখে চোখ নাচিয়ে বললেন, শুনেছিস?
কি?
মুক্তিবাহিনী সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু করেছে। একেবারে যাকে বলে ফাটাফাট। যেরকম সেরকম যুদ্ধ না, একেবারে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে যুদ্ধ! বুঝলি, মনে হয় চুল টুল কেটে ছেলে সেজে বের হয়ে যাই মুক্তিযুদ্ধে!
আমি অরু আপার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে তুমি কোন কথা বলতে পারবে না। কথা বললেই সবাই বুঝে যাবে তুমি মেয়ে!
অরু আপা গলার স্বর মোটা করে বললেন, আমি এই রকম করে কথা বলব, তাহলে হবে না?
আমি অরু অপাের ভাবভঙ্গি দেখে খুকধুক করে হেসে ফেললাম। অরু আপা রেডিওটা বন্ধ করে বললেন, তুই দেখি আজকাল আর আসিস না?
এই তো এসেছি।
নিশ্চয়ই কোন দরকারে এসেছিস। কি দরকার?
তুমি কাউকে বলবে না তো?
আমাকে বিয়ে না করে আর কাউকে বিয়ে করে ফেলেছিস?
যাও! খালি ঠাট্টা তোমার।
ঠিক আছে বলব না। কি দরকার?
আমি খুব সরল মুখ করে একটা বড় মিথ্যা কথা বললাম, আব্বা আমাকে ছয় পৃষ্ঠা ট্রানশ্লেশান করতে দিয়েছে।
ছয় পৃষ্ঠা? অরু আপা ভয় পাওয়ার ভান করে বললেন, এত বড় অত্যাচার? তোর আব্বা কি পাকিস্তানী মিলিটারীদের সাথে যোগ দিয়েছে?
ভেবেছিলাম শেষ করে ফেলব। কিন্তু —
শেষ হয় নাই?
না।
আমি এখন তোর ট্রানশ্রেশানগুলি করে দেব?
আমি মাথা নড়িলাম।
কভি নেহী। অরু আপা তার হাতের তালুতে একটি কিল দিলেন।
অরু, আপা আর তোমাকে বলব না, এই শেষ বার। তোমাকে তো করে দিতে হবে না, আমি নিজেই করব। শুধু যেখানে আটকে যাব সেখানে বলে দেবে। দেবে? প্লীজ!
ঠিক আছে যা। শুধু একটা শর্ত।
কি শর্ত?
বিয়ের পর আমাকে এক ভরি সোনা দিয়ে একটা নাকফুল—
যাও। খালি তোমার ঠাট্টা। একটা দরকারী জিনিস নিয়ে কথা বলছি—
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে বল।
এই যে ট্রানশ্লেশন— ছয় পৃষ্ঠা ট্রানশ্রেশান তুমি আমাকে দেখিয়ে দেবে সেটা আমার আম্মাকে না হয়। আকবাকে বলবে না।
ঠিক আছে বলব না।
সেটা করার জন্যে আমি আজকে রাতে তোমার কাছে চলে আসব।
সে কি? অরু আপা অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়ি চলে আসবি মানে?
অরু আপা মুখে আচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে চলে আসিস।
বেশি যদি রাত হয় তাহলে থেকে যাব এখানে। তুমি তাহলে প্রিন্স এন্ড পপার বইটা পড়ে শোনাতে পারবে। মনে আছে একটু বাকি আছে?
অরু, আপা বললেন, ঠিক আছে।
আমি অরু অ্যাপাকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম, কোন কিছু সন্দেহ করলেন না। আমি নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললাম, তুমি আম্মাকে এখানে থাকার কথাটা বলে দেবে তাহলে? ট্রানশ্লেশানের কথা বল না।
ঠিক আছে বলে দেব।
আমি খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম। আমার ফন্দীটার কঠিন অংশটা করা হয়ে গেছে। ব্রাত্রি বেলা বের হবার সময় আম্মাকে বলব। অরু, আপার বাসায় যাচ্ছি বাসায় কেউ সন্দেহ করবে না। তারপর অরু, আপার বাসায় এসে বলব। অরু আপা আজ রাতে আসতে পারব না, আরেকদিন। অরু আপা কিছু সন্দেহ করবে না, আবার আব্বা আম্মা কিছু জানতে পারবে না।
নিখুঁত পরিকল্পনা। তবু আমার বুকটা ধ্বকঞ্চবক করতে লাগল। আমি খানিকক্ষণ চেষ্টা করে নিজেকে একটু শান্ত করলাম। অরু আপার সাথে এত বড় একটা মিথ্যা কথা বলার জন্যে খুব খারাপ লাগছিল, কিন্তু দুষ্টুমী করে তো বলছি না। দেশের একটা কাজের জন্যে বলছি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বলছি।
অরু আপা আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, বললেন, কি রে? হঠাৎ করে বুড়ো মানুষের মত এত গম্ভীর হয়ে গেলি?
আমি জোর করে একটু হেসে বললাম, কে বলেছে গম্ভীর হয়েছি।
হ্যাঁ, তোরা ছোট মানুষ হাসি খুশি থাকবি। ছোট মানুষকে গভীর দেখালে খুব খারাপ লাগে।
আচ্ছ অরু, আপা তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?