এইটুকু ছেলে, আমাকে এসে বলে –
কি বলে?
বলে, বলে— আজরফ আলী কথা বন্ধ করে হিংস্ৰ চোখে এদিকে সেদিকে তাকাতে থাকে।
আমি রাশেদের সাহস দেখে বোকা বনে যাই। একেবারে আজরফ আলীর নাকের সামনে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, তার আশে পাশে আরো নানা বয়সী ছেলে। এত জনের মাঝে আজরফ আলী কেমন করে রাশেদকে খুঁজে বের করবে? তা ছাড়া শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল, চেহারাও তো দেখেনি আজরফ আলী।
একজন রাজাকার এবারে হুংকার দিয়ে বলল, সবাই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন নাকি? যান যান, সরেন।
লোকজন সরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখালো না। মজার গন্ধ পেয়ে বরং আরো বেশি লোক জমে যেতে শুরু করল। আজরফ আলী বেকায়দায় পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই খুব ব্যথা পেয়েছে, দরদরি করে ঘামিছে। দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, এখনো মাছের মত খাবি খাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, আবার ধাপ করে বসে পড়ে কোঁকাতে লাগল।
রাজাকার দুইজন আবার লোকজনকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোন লাভ হল না। ভিড় বরং আরো বেড়ে যেতে থাকে। শেষে কোন উপায় না দেখে একটা রিকশা থামিয়ে সেখানে আজরফ আলীকে তুলে সরিয়ে নেয়। সে তখনো যন্ত্রণায় কেঁ কেঁ। করে দরদরি করে ঘামিছে।
লোকজন সরে গেলে আমি রাশেদকে ফিসফিস করে বললাম, তুই তো সাংঘাতিক মানুষ! ডেঞ্জারাস!
রাশেদ দাঁত বের করে হেসে বলল, এইটা তো খালি মজা করলাম। যখন সত্যিকার টাইট হবে সেদিন বুঝবে মজা।
রাত্রে শুনলাম আব্বা আম্মাকে বলছেন, শুনেছি আজরফ আলীর কি হয়েছে আজ?
কি হয়েছে তার?
একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে ধরেছিল রাস্তায়। বলেছে তোমার দিন শেষ। কলমা পড়–
তাই বলেছে? মুক্তিযোদ্ধা?
হ্যাঁ। মুক্তিযোদ্ধার কাছে স্টেনগান ছিল, স্টেনগানটা যেই বের করবে। তখন দুইজন রাজাকার এসে হাজির।
সৰ্ব্বনাশ! তারপর?
কেউ কেউ বলছে তখন একটা যুদ্ধ হয়েছে, কেউ কেউ বলছে। যুদ্ধ হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাটি বাতাসের মত উবে গিয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, আব্বা হাসতে হাসতে বললেন, আর আজরফ আলী মনে করেছে রাজাকার দুজন মুক্তিযোদ্ধা। তখন নাকি তাদের পা ধরে ভেউভেউ করে কান্না!
সত্যি? মুক্তিবাহিনী তাহলে শহরে নামতে শুরু করেছে?
তাই তো মনে হয়।
আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না।
পরদিন আমি আর রাশেদ মিলে আজরফ আলীর কাছে দুই নম্বর চিঠিটা পাঠালাম। সেটা শুরু হল। এইভাবে :
এই বার তুই রাজাকারের পায়ে মুখ ঘষেছিস, মাপ চেয়েছিস— তারা তোকে মাপ করে দিয়েছে। আর কয়েকদিনের মাঝে আমি যখন তোর সামনে দাড়াব আমার পায়ে মুখ ঘষে তোর কোন লাভ হবে না! আমি তোকে মাপ করব না। …
০৯. সপ্তাহখানেক পরে একদিন
সপ্তাহখানেক পরে একদিন খুব সকালে রাশেদ এসে হাজির। স্কুল নাই কিছু নাই সকালে উঠার তাড়া নাই, ঘুম থেকে উঠতে উঠতে কোনদিন বেলা দশটা বেজে যায়। রাশেদ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আমি চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে বললাম, তুই? এত সকালে?
মোটেও সকাল না। দশটা বাজে।
দশটা বেজে গেছে?
হ্যাঁ। রাশেদ চিন্তিত মুখে বলল, খালাম্মা মনে হয় তোর উপর একটু রেগে আছেন।
কেন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইবু কি বাসায় আছে? খালাম্মা বললেন, লাট সাহেব এখনো ঘুমাচ্ছে, দেখি তুলতে পাে=র। কিনা। বিছানা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে বললেন তোকে।
আমি চোখ থেকে ঘুম সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, আম্মা এভাবেই কথা বলে! তুই এত সকালে এসেছিস কেন?
খবর আছে।
আমার ঘুম চটে গেল, কি খবর?
এখানে বলা যাবে না। বাইরে যেতে হবে।
এখনো মুখ ধুই নি, নাস্ত করি নি।
তাহলে মুখ ধুয়ে নাস্ত কর। বিছানায় লাট সাহেবের মত শুয়ে আছিস কেন?
আমি উঠে মুখ ধুয়ে এলাম। আম্মা রাশেদকে বললেন, আস তুমি ইরুর সাথে নাস্তা কর।
না খালাম্মা আমি নাস্তা করে এসেছি।
আরেকটু খাও।
না খালাম্পমা। যদি বলেন এক কাপ চা খেতে পারি।
চা?
হ্যাঁ। কড়া লিকার রং চা। ফ্রেস পাত্তি।
আম্মা একটু অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বুঝতে একটু সময় লাগল ‘কড়া লিকার রং চা ফ্রেস পাত্তি’ মানে কি। রাশেদ যখন আজীজ মিয়ার রেস্টুরেন্টে চা খেতে যায় চা অর্ডার দেবার সময় সব সময় এইটা বলে। বাসায় আমাকে চা খেতে দেয়া হয় না, কিন্তু আম্মা রাশেদকে নতুন চায়ের পাতা দিয়ে কড়া লিকারের দুধ ছাড়া চা তৈরি করে দিলেন। আমি যখন নাস্তা করছিলাম রাশেদ তখন খুব সখ করে তার চা চুমুক দিয়ে দিয়ে খেল।
নান্ত করে আমি রাশেদকে নিয়ে বের হলাম। বাসার সামনে দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রাশেদ গলা নামিয়ে বলল, মুক্তিবাহিনী এসে গেছে।
এসে গেছে?
হ্যাঁ।
কোথায়?
নদীর ওপারে।
সত্যি?
হ্যাঁ। ছোট একটা দল এসেছে স্পেশাল মিশনে।
কি মিশন?
স্পেশাল মিশন।
সেটা আবার কি?
রাশেদ মাথা নাড়ল, আমি জানি না। আমাদের সাথে দেখা করতে চায়।
আমি চমকে উঠলাম, কার সাথে?
আমাদের সাথে।
কেন?
মনে আছে আমার স্কুলের ম্যাপ তৈরি করেছিলাম? মিলিটারী ক্যাম্পের সবকিছু দিয়ে? মনে আছে?
হ্যাঁ।
সেইটা মুক্তিবাহিনীর খুব পছন্দ হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কেমন করে পেলে তারা?
আমি দিয়েছি।
তুই কেমন করে দিলি?
রাশেদ রহস্যময় ভঙ্গিতে হয়সে, মাথা নেড়ে বলে আমার সব জায়গায় কালেকশান আছে।
তারা এখন আমাদের সাথে দেখা করতে চায়?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমরা— আমরা এত ছোট?
ছোট আর বড় আবার কি, দায়িত্ব নিয়ে কথা। ছোট বলে আমরা বড় দায়িত্ব নিতে পরি না?