রাজাকার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভাল দেখায় না, আমরা তাই হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম তখন শুনলাম চুম্বু মিয়া বলল, আজরফ আলী চেয়ারম্যানকে চিনিস তো?
জে।
এক্ষুনি গিয়ে খবরটা দিবি। দেরি যেন না হয় শুওরের বাচ্চারা।
জে, দেরি হবে না।
যা হারামজাদারা, যা।
আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে রওনা দিলাম, চুন্ন মিয়ার এবং রাজাকার বাহিনীর লোকজনের কথাবার্তা খুব খারাপ, গলাগলি না দিয়ে কথা বলতে পারে না। আমরা হেঁটে যেতে যেতে দেখি, রাজাকার দুইজন পিছনে পিছনে আসছে। তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে কিন্তু দুইজনের কোন তাড়া নেই, একটা পান দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে দুইজন।
শান্তি কমিটির অফিসের কাছাকাছি আসতেই দেখি আজরফ আলী আসছে। সাথে কেউ নেই, একা। রাশেদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বলল, তুই চলে যা, আমি একটা মজা করি।
কি মজা?
দেখবি এক্ষুনি, তুই চলে যা। তোকে যেন না দেখে।
আমি তাড়াতাড়ি একটা গলিতে ঢুকে গেলাম।
রাশেদ শার্টের একটা বোতাম খুলে মাথার উপরে তুলে মুখটা ঢেকে ফেলল যেন তার চেহারা চেনা না যায়। তারপর আজরফ আলীর কাছে ছুটে গিয়ে বলল, পাকিস্তানী দালাল দুইজন মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ মিনিটের মাঝে তোকে গুলী করে মারবে।
কি বললি? কি বললি? কি? কি?
রাশেদ ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে। আজরফ আলীকে কেমন জানি একটু ভীত দেখাল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রাশেদ যেদিক দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে আবার হেঁটে যেতে থাকে। মনে হয় পুরো ব্যাপারটা সে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে থমকে দাড়ায়, রাস্তার অন্য পাশে রাইফেল হাতে দুজন রাজাকারকে দেখতে পেয়েছে। তারাও আজরফ আলীকে দেখে ছুটে আসছে আজরফ আলীর দিকে।
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম রাশেদ কি করেছে। রাজাকার দুজনকে দেখে আজরফ আলী মনে করেছে তারা মুক্তিবাহিনী, তাকে মারতে আসছে। ভয়ে, আতংকে তার চোয়াল ঝুলে পড়ল। চিৎকার করে ঘুরে গেল, তারপর প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। আমার সামনে দিয়ে প্রথমে ছুটে গেল আজরফ আলী, তার পিছনে পিছনে দুজন রাজাকার। আমি গলি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম, বিশাল থলথলে দেহ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে আজরফ আলী। হেঁচট্ট খেয়ে পড়ল একবার, কোনমতে উঠে দাঁড়াল, তারপর আবার চিৎকার করে ছুটতে থাকে। আবার আছড়ে খেয়ে পড়ল, কোন মতে উঠে দাঁড়াল, তারপর সাথে সাথেই পা বেধে আবার হোচট খেয়ে পড়ল। এবারে আর উঠতে পারল না, কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করল, উঠতে না পেরে হামাগুড়ি দিয়েই যেতে থাকে। আর প্রাণপণে চিৎকার করতে থাকে। মােটা, বয়স্ক মানুষ, দৌড়ে অভ্যাস নেই, বেকায়দা পড়ে হাত-পা কিছু ভেঙে গেছে কি না কে জানে।
রাজাকার দুজন এতক্ষণে দৌড়ে তার কাছে এসে গেছে। আজরফ আলী হঠাৎ দুই হাত জোড় করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি এর আগে কোন মানুষকে এত ভয় পেতে দেখি নাই, এবারে দেখলাম। এটাকে নিশ্চয়ই মৃত্যুভয় বলে। কি ভয়ংকর আতংক তার চোখে-মুখে, মরার আগে মানুষ মনে হয় এভাবে তাকায়।
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আজরফ আলী দুই হাত জোড় করে রাজাকার দুইজনের সামনে মাথা নিচু করে বলতে থাকে, বাবারা, আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও। আল্লাহর কসম লাগে বাবার। আমি ইচ্ছা করে করি নাই, জান বাঁচানোর জন্যে করেছি। আমি জয় বাংলার পক্ষে, আমি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। আমি মাপ চাই, মাপ চাই—
দেখতে দেখতে ভিড় জমে যায় তাকে ঘিরে। রাজাকার দুইজন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু এগিয়ে আসতেই আজরফ আলী একেবারে তাদের পা জড়িয়ে ধরে। একজনের পায়ে মুখ ঘষতে থাকে, তার দাড়িতে জুতার ময়লা লেগে নোংরা হয়ে যায়। তার টুপি খুলে পড়ে টাকমাথা বেরিয়ে যায়। চোখের পানিতে নাকের পানিতে কুৎসিত দেখাতে থাকে তাকে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি এই মানুষটার দিকে। আবার কেমন জানি গা শির শির করতে থাকে, ঠিক বুঝতে পারি না কেন— কিন্তু আমার কেমন জানি এক ধরণের লজ্জা করতে থাকে। মানুষকে এত ছোট হতে দেখলে নিশ্চয়ই লজ্জা লাগে সবার। কিন্তু আমি চলেও যেতে পারছিলাম না। নিষিদ্ধ জিনিস দেখার একরকম আকর্ষণ থাকে, আমি সেই আকর্ষণের মাঝে আটকা পড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাজাকার দুজনের একজন তখন আজরফ আলীকে টেনে তুলে বলল, হুজুর, আমরা মুক্তিবাহিনী না, আমরা রাজাকার বাহিনী।
হঠাৎ করে আজরফ আলী মনে হল নিজের ভুল বুঝতে পারল। বোকার মত রাজাকার দুইজনের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে অন্য সব মানুষজনের দিকে তাকাল। আমি দেখতে পেলাম প্রচণ্ড রাগে তার মুখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠেছে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। তাকে ঘিরে অনেক বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে, সে তাদের মাঝে রাশেদকে খুঁজছে। হঠাৎ আমি আতংকে একেবারে সিটিয়ে গেলাম— একেবারে আজরফ আলীর ন্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ! যদি চিনে ফেলে? কিন্তু চিনতে পারল না, বৃথাই রাশেদকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে করতে হিংস্র স্বরে বলল, কোথায় সেই শুওরের বাচ্চা? কোথায়?
একজন জিজ্ঞেস করল, কে?
শুওরের বাচ্চ বদমাইশ ছোড়া –
কে? কি করেছে?
আমি যদি তার চৌদ্দ গুণ্ঠিকে শিক্ষা না দেই! বাপ চাচা সবাইকে যদি এক কবরে মাটি না দেই! ভিটা মাটিতে যদি শকুন না চড়াই তাহলে আমার নাম আজরফ আলী না।
একজন রাজাকার জিজ্ঞেস করে, কার কথা বলছেন হুজুরী? কার কথা?