স্কুলে যে জন্যে যেতে হচ্ছে না। সে জন্যে অন্য কিছুই করা যাচ্ছে না। আমাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ। খেলাধুলা বন্ধ। মাঝখানে স্কুলের ম্যাপটা নিয়ে কাজ করেছিলাম, সেটাও শেষ হয়েছে। রাশেদ এখন তার মাঝে অন্যান্য জিনিসগুলি লিখছে। দিলীপের সাথে আমি অনেক খেলতাম, সে এখন কোথায় আছে জানি না। আশরাফ আর ফজলুর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। কিন্তু দুজনেই বেশ মনমরা। রাশেদ শুধু মাত্র মুখ শক্ত করে ঘুরে বেড়ায়। তার ধারণা, মুক্তিবাহিনী এল বলে, তারপর মিলিটারী, রাজাকার আর দালালদের অবস্থা একেবারে কেরোসিন হয়ে যাবে।
আমার বাসার বাইরে বেশিদূর যাওয়া নিষেধ। তবু আমি মাঝে মাঝে একটু ঘুরে আসি। আমার বয়সী বাচ্চাদের বেশি ভয় নেই। রাস্তাঘাটে বেশ কয়েকবার মিলিটারীদের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে। আমার বুক ধুকধুক করেছিল। কিন্তু তারা কিছু করেনি। আস্তে আস্তে আমারও সাহস বেড়েছে, মিলিটারী দেখলে মাঝে মাঝে তাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াই। সব সময় তারা এক সাথে গুলি অনেক থাকে। দোকানপাটে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে দাম না দিয়ে বের হয়ে আসে। একদিন একজন দাম চাইতেই রাইফেলের বট দিয়ে পেটে গদাম করে মেরে বসল। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল লোকটার।
বাসায় এসে অবিশ্যি আমি সেগুলি বলি না। বললে আর বাসা থেকে বের হতে দেবে না। আব্বার মুখে শুধু একটাই কথা, ঘরে বসে ইংরেজি ট্রনিক্লেশান করতে পারিস না?
একদিন সকালে রাশেদ এসে বলল, তোর কাছে দশ পয়সা হবে?
কেন?
সে গলা নামিয়ে বলল, একটা খাম| কিনতে হবে। দশ পয়সা কম পড়েছে।
কাকে চিঠি লিখবি?
রাশেদ আরো গলা নামিয়ে বলল, আজরফ আলীকে।
কি লিখবি?
লিখে ফেলেছি। এই দ্যাখ। সে সাবধানে পকেট থেকে রুলটোনা একটা কাগজ বের করল। উপরে এক পাশে লেখা ‘জয় বাংলা’, অন্যপাশে লেখা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, তার নিচে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখাঃ
শালা আজরফ আলী,
তুই পাকিস্তানের দালাল মীরজাফর। বিশ্বাসঘাতক। তুই শুধু যে বিশ্বাসঘাতক তাই না, তুই মুখে ইসলামের কথা বলিস। কিন্তু তুই ইসলামের কোন কাজ করিস না। আল্লাহ তোকে সেইজন্যে হাশরের ময়দানে কখনো ক্ষমা করবে না। এই পৃথিবীতে আমরাও তোকে ক্ষমা করব না। তোর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তুই ভাল-মন্দ খেতে চাস তো তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, কারণ আর কয়েকদিনের মাঝেই তোর জায়গা হবে। জাহান্নামে। সেখানে তুই খাবি দোজখের আগুন। হা হা হা হা হা।
ইতি — আজরাইল
আমি অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকলাম। রাশেদ মুচকি হেসে বলল, শালার ব্যাটাকে একটু ভয় দেখিয়ে দেই।
কিন্তু দেখে তো বোঝা যাচ্ছে এটা তোর হাতের লেখা- একটা ছোট ছেলের হাতের লেখা।
রাশেদ মাথা চুলকে নিচে আরো একটা লাইন লিখে দিল, হাতের লেখা দেখে যেন চিনতে না পারিস সে জন্যে বাম হাতে লিখলাম।
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, এবারে ঠিক হয়েছে, মনে করবে। বাম হাতে লিখেছে বলে হাতের লেখা এরকম ক্যাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং।
রাশেদ মেঘস্বরে বলল, আমার হাতের লেখা কখনোই ক্যাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং না। বেশি কথা না বলে দশ পয়সা থাকলে দে।
আমি আর তর্ক করলাম না, দশ পয়সা বের করে দিলাম। তারপর দুজনে মিলে পোস্ট অফিসে হেঁটে গিয়ে একটা খাম কিনে উপরে আজরফ আলীর ঠিকানা লিখে, ভিতরে চিঠিটা দিয়ে একটা চিঠির বাক্সে ফেলে দিলাম।
দুদিন পরে রাশেদ এসে বলল, চিঠিতে কাজ হয়েছে মনে হয়।
কেন?
আজরফ আলীর অবস্থা কোরোসিন! আর ঘর থেকে বের হয় না। রাশেদ খুব খুশি হয়ে খিকখিক করে হাসতে থাকে।
আমি আর রাশেদ মিলে আজরফ আলীর বাসার কাছে দিয়ে হেঁটে এলাম। দেখলাম, দুইজন রাজমিস্ত্রী বাসার সামনের দেওয়ালের উপর ইট গেঁথে সেটাকে আরো উছু করছে। সামনে একজন রাজাকার রাইফেল হাতে পাহারা।
এর দুইদিন পর রাশেদ এমন একটা কাজ করল যে বলার নয়। আমি সেদিন রাশেদের সাথে বাজারের কােছ দিয়ে আসছি, শাস্তি কমিটির অফিসের সামনে একটু দাঁড়ালাম। আওয়ামী লীগের অফিসটা পুড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাপের অফিসটা পোড়ায়নি, শুধু ভাঙচুর করেছে, সেটাই এখন ঠিকঠাক করে শান্তি কমিটির অফিস। শান্তি কমিটির কাজকর্ম খুবই সহজ, রাজাকার বাহিনী নিয়ে মানুষজনের ঘরবাড়ি লুটপাট করে আনা। যাদের সাথে শত্ৰুতা আছে মিলিটারী নিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে গুলী করে মারা। কেউ মুক্তিবাহিনীতে গেছে। খবর পেলে তাদের ঘরবাড়ি জ্বলিয়ে দেওয়া। মাঝে মাঝে মিলিটারীরা যখন কাউকে ধরে আনে। তখন তাদের আত্মীয়স্বজনরা এসে শান্তি কমিটির লোকজনের পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করে। কেউ তখন খালি হাতে আসে না, টাকা পয়সা নিয়ে আসতে হয়।
আমরা উঁকি মেরে দেখলাম, অফিসের ভিতর আজরফ আলী একটা চেয়ারে খুব রাগ-রাগ চেহারা করে বসে আছে। তার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে একজন বুড়ো মানুষ হাউমাউ করে কাঁদছে। আহা বেচারা! নিশ্চয়ই তার ছেলেপিলে কাউকে মিলিটারী ধরে নিয়ে এসেছে।
খানিকক্ষণ সেটা দেখে আমরা রাজাকার বাহিনীর অফিসে গেলাম। আগে সেটা নগেন ডাক্তারের চেম্বার ছিল। নগের ডাক্তার পুরানো আমলের এল. এম. এফ. ডাক্তার, খুব ভাল ডাক্তার। দুই-তিনটা এম. বি. বি. এস. ডাক্তার নাকি পকেটে রেখে দিতে পারেন। নাড়ি ধরে নাকি বলে দিতে পারতেন রোগী দুদিন আগে কি খেয়েছে। নগেন ডাক্তারকে সবাই ইণ্ডিয়া চলে যেতে বলেছিল, কিন্তু তিনি কিছুতেই যেতে রাজি হননি। সারা জীবন এখানে কাটিয়েছেন, এটা তার মাটি, এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। মিলিটারী আসার এক সপ্তাহ পরে রাজাকার বাহিনী তৈরি হল, তারা এসে নগেন ডাক্তারকে গুলী করে মেরে তার চেস্বরটা দখল করে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর অফিস তৈরি করেছে। আমরা সময় পেলে রাজাকার বাহিনীর অফিসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি। কি করে না করে সেটা দেখি। আজকেও দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন দেখি চুয়ু মিয়া দুইজন রাজাকার নিয়ে বের হল। চুন্ন মিয়ার হাতে কিছু নেই। কিন্তু অন্য দুইজন রাজাকারের হাতে একটা করে রাইফেল। চুমু মিয়া আগে ঠ্যালাগাড়ি ঠেলত, মিলিটারী আসার পর এক লাফে রাজাকার কমান্ডার হয়ে গেছে।