কি?
সব মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে গেছে। একদিন স্বাধীন বাংলা হবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হবে মনে হয় তোর?
হ্যাঁ, অরু, আপা। ঠিক হবে।
আবার আমরা কলেজে যাব? তোরা ফুটবল খেলবি? গোল খেয়ে মুখ কাল করে ফিরে আসবি? আমরা মোড়ের দোকান থেকে লজেন্স কিনে আনব?
হ্যাঁ, অরু, আপা।
অরু, আপা আমাকে কাছে টেনে নিলেন, আমি দেখলাম তার চোখে পানি টলটলে করছে।
রাশেদ বিকাল বেলা আমাদের সাথে দেখা করতে এল। আমরা দুইজন দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। একটু পরে ফজলুও এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। আমরা চুপচাপ বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আবার মানুষজন রাস্ত দিয়ে যাচ্ছে আসছে। রিকশা, সাইকেল যাচ্ছে কিন্তু তবু যেন আগের মত নয়। আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ
হুঁ।
কি?
জোরেসোরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একটা দল যাচ্ছে, তিন সপ্তাহের টেনিং দিয়ে স্টেনগান আর গ্রেনেড হাতে দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
স্টেনগান?
হ্যাঁ।
সেটা কি রকম?
ছোট। ভাজ করে লুকিয়ে রাখা যায়। অটোমেটিক। ট্রিগার টেনে রাখলেই গুলী বের হতে থাকে ট্যাট ট্যাট ট্যাট…। সাথে কার্তুজের ক্লীপ থাকে। একটা শেষ হলে আরেকটা লাগিয়ে নেয়।
আর গ্রেনেড?
গ্রেনেড হচ্ছে বোমা। দাঁত দিয়ে পিন খুলে ছুঁড়ে মারতে হয়। তিন সেকেন্ড পরে ফাটে। বুম। মিলিটারী শালাদের আর রক্ষা নাই।
রাশেদ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলল, এই দ্যাখ।
কি?
লিস্ট করছি।
কিসের লিস্ট?
দালালদের লিস্ট। কারা কারা জয় বাংলার বিপক্ষে।
আমরা লিস্টটা দেখলাম। প্ৰথমে খান সাহেবের নাম। তারপর আজরফ আলী। তারপর আরো কয়েকজনের নাম, আমি চিনি না। কারো নামের পাশে লেখা মুসলীম লীগ, কারো নামের পাশে লেখা জামাতে ইসলামী, কারো নামের পাশে লেখা ইসলামী ছাত্র সংঘ, কারো নামের পাশে লেখা নিৰ্দলীয় সুবিধাবাদী। কে কোথায় থাকে তার ঠিকানা।
রাশেদ বুঝিয়ে দিল, খান সাহেবের নামের পাশে এই কাটা চিহ্ন মানে বুঝেছিস?
মানে মরে গেছে এর মাঝে?
হ্যাঁ। মিলিটারীই মেরেছে!
এই লিস্ট দিয়ে কি করাবি?
যখন মুক্তিবাহিনী আসবে তাদের দিব। স্বাধীনতার প্রথম কাজই হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকদের খতম করা। যদি তাদের খতম না করিস তাহলে—
তাহলে কি?
তাহলে দশ বিশ বছর পরে তারা আবার পাকিস্তানীদের ডেকে আনবে।
ধুর! সেটা আবার কেমন করে হবে?
হয়। আমি পড়েছি বইয়ে।
আমার চুপ করে গেলাম। সত্যি সত্যি যদি সে বইয়ে পড়ে থাকে তাহলে তো আর এটা নিয়ে তর্ক করা যায় না। আর এটা তো সবাই জানে রাশেদ হচ্ছে রাজনীতির মানুষ, সে যদি ‘প্রেতপুরীর অট্টহাস্য’ না পড়ে রাজনীতির বই পড়ে তাহলে অবাক হবার কি আছে?
রাশেদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন আমাদের এই লিস্টটা শেষ করতে হবে। তারপরে ম্যাপ তৈরি করতে হবে।
ম্যাপ? কিসের ম্যাপ?
আমাদের স্কুলের। মিলিটারীরা ক্যাম্প করেছে তো, মুক্তিবাহিনী যখন আক্রমণ করবে—
আমরা তো ম্যাপ তৈরি করেছিলাম, মনে আছে? ফজলু চোখ বড় করে তোকাল, মনে আছে?
আমার মনে পড়ল। গত বছর আমরা দিনরাত গুপ্তধন গুপ্তধন খেলতাম। একদল গুপ্তধন লুকিয়ে রাখত অন্যদল সেটা খুঁজে বের করত। গুপ্তধন কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা ম্যাপে দেখানো থাকত। আমরা অনেক যত্ন করে সেইজন্যে স্কুলের ম্যাপি তৈরি করেছিলাম। সব শুনে রাশেদের চোখ চকচক করতে থাকে। বলে, কোথায় আছে সেই ম্যাপ?
আমি আর ফজলু মাথা চুলকালাম, কারণ আমাদের জিনিসপত্র কখনোই ঠিক জায়গায় থাকে না। ফজলু বলল, আশরাফের কাছে নিশ্চয়ই আছে।
হ্যাঁ, আমি মাথা নাড়লাম, আশরাফই আসলে বেশি কাজ করেছে। মনে আছে, গ্রাফ পেপারে মেপে মেপে সব কিছু ঐকেছে?
হ্যাঁ, কোথায় পুকুর, কোথায় লাইব্রেরি, জামরুল গাছ। তখন, মনে আছে আমরা কত বিরক্ত হয়েছিলাম আশরাফের উপর? সব সময় যে বাড়াবাড়ি করত!
রাশেদ হাতে থাবা দিয়ে বলল, এই ম্যাপ যদি থাকে তাহলে তো আর কোন চিন্তাই নাই। এখন কোনখানে বাংকার, কোনখানে ট্রেঞ্চ, কোনখানে গোলাগুলী সেগুলি বসিয়ে দিলেই হবে। তারপর যখন মুক্তিবাহিনী আসবে—
তখন কি হবে?
এই ম্যাপ দেখে ফাইট হবে!
সত্যি?
হ্যাঁ। রাশেদ আমাদের দিকে তাকাল। চকচকে চোখে বলল, তোরা আমাকে সাহায্য করবি?
করব।
টপ সিক্রেট কিন্তু। একবারে টপ সিক্রেট।
ঠিক আছে।
উত্তেজনায় হঠাৎ আমাদেরও বুক কেমন করতে থাকে। আমরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেই, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
রাস্তায় লোকজন হঠাৎ দ্রুত এদিকে সেদিকে সরে যেতে থাকে। রাশেদ ফিসফিস করে বলল, মিলিটারী আসছে। মিলিটারী।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। প্রথমে শুকনো কয়েকজন মানুষ,
রাইফেল হাতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় বাঙালী। রাশেদ ফিসফিস করে বলল, রাজাকার বাহিনী।
রাজাকার বাহিনীর পিছু পিছু একদল মিলিটারী। চকচকে কাপড় পরা। হাতে অস্ত্রশস্ত্র। কোমরে গুলীর বেল্ট।
রাশেদ ফিসফিস করে বলল, চাইনিজ মেশিনগান।
মিলিটারীগুলি এক লাইনে হেঁটে যাচ্ছে। বুটের শব্দ হচ্ছে পাকা রাস্তায়। কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
রাশেদ দেওয়াল থেকে নেমে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছিস?
দেখি মিলিটারীরা কি করে।
রাশেদ মিলিটারীদের পিছু পিছু হেঁটে যেতে থাকে। আমারও কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু আব্বার কড়া নিষেধ কোথাও যাওয়া যাবে না।
সন্ধ্যেবেলা পূর্বদিকে লাল হয়ে রইল। মনে হল আগুন লেগেছে। মিলিটারীরা ওদিকেই যাচ্ছিল।
০৮. আমাদের স্কুলে যেতে হয় না
অনেকদিন থেকেই আমাদের স্কুলে যেতে হয় না। আমার ধারণা ছিল স্কুলে না। যাওয়ার থেকে আনন্দের বুঝি আর কিছু নেই। কিন্তু কয়দিন থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা সেরকম না।