মিলিটারীরা তাদের ঘাটি করুল আমাদের স্কুলে। একটা বড় কুৎসিত পাকিস্তানী পতাকা টানিয়ে দিল বদমাইশগুলি।
রাত্রে ছাড়াছাড়াভাবে গোলাগুলি হল। কাকে গুলী করেছে কে জানে। আমরা সারারাত গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম।
পরের দিন সকালবেলা আবার রাশেদ এসে হাজির হল। আকবা অবাক হয়ে বললেন, আবার বের হয়েছ তুমি?
রাশেদ মাথা নাড়ল।
কোন খবর আছে?
জী। আজরফ আলী একটু আগে মিলিটারী ক্যাম্পে গেছে।
আজরফ আলী কে?
পাকিস্তানী দালাল। তিন বউ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিলিটারীরা মেরে ফেলে নাই?
না। সাথে একটা বড় পাকিস্তানী ফ্ল্যাগ নিয়ে গেছে। মাথায় টুপি পরে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করতে করতে গেছে। মিলিটারীরা মারে নাই সেজন্যে।
আমি বললাম, মারা উচিত ছিল।
আবাবা কেমন জানি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
পরের কয়দিন শহরে একটার পর একটা বাসা লুট করা হল, বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হল। আমরা বাসায় বসে থেকে দেখলাম ধোয়া উড়ছে, সাথে মানুষের চিৎকার। ভয় নয় আনন্দের চিৎকার। দিলীপদের বাসা লুট হল বুধবারে। দুপুর বেলা আজরফ আলী দুইজন মিলিটারী নিয়ে এল, সাথে আরো কিছু মানুষ, সবার মাথায় টুপি। আজকাল যেদিকেই তোকানো যায় সেদিকেই দেখি টুপি। মিলিটারী দুইজন প্রথমে বাসাটার চারদিকে ঘুরে দেখল তারপর কয়েকবার খামোেকা বাসার এখানে—সেখানে ধাক্কা দিল। শেষে সামনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লাথি মেরে দরজাটা ভেঙে ফেলল। মনে হয় ব্যাটাদের গায়ে মোষের মত জোর।
প্রথমে ভিতরে ঢুকাল মিলিটারী দুইজন, পিছু পিছু আজরফ আলী। খানিকক্ষণ ভিতর থেকে ধুমধুম শব্দ হল, মনে হল কিছু একটা ভাঙছে। মিলিটারী দুইজন আর আজরফ আলী বের হয়ে এল একটু পরে। একজনের হাতে দিলীপাদের টেপ রেকর্ডার। দিলীপের বাবার খুব গান শোনার শখ ছিল। আরেকজন মিলিটারীর হাতে ছোট একটা বাক্স, বাক্সের ভিতরে কি আছে বোঝা গেল না। আজরফ আলীর হাতে কিছু নেই, বাইরে এসে সে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে বলল, এই মালাউনের বাচ্চ ইণ্ডিয়া ভোগে গেছে। এর মালসামান এখন গণিামতের মাল। এখন এই মালসামান—
কথা শেষ করার আগেই টুপি-পরা লোকগুলি চিৎকার করে দিলীপাদের বাসায় ঢুকে গেল, তাদের বাসার জিনিসপত্র টেনে বের করতে লাগল। একজনকে দেখলাম দেওয়াল ঘড়িটা বগলে নিয়ে ছুটছে। কতবার দিলীপাদের বাসায় এই ঘড়িতে সময় দেখেছি! কয়েকজন মিলে দেখলাম দিলীপাদের চালভর্তি ড্রামটা টেনে টেনে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় কিছু মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মিলিটারীরা তাদেরকেও ডাকল লুট করার জন্যে। লোকগুলি লুট করতে চাইছিল কি না জানি না কিন্তু কারো না করার সাহস হল না, ভয়ে ভয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। একটু পরে দেখলাম, তারাও যাহা উৎসাহে লুট করা শুরু করেছে।
আম্মা জানালার কাছে দিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আস্তে আস্তুে বললেন, হায় খোদা, তুমি কেমন করে সহ্য করছ? কেমন করে?
সন্ধ্যেবেলা থেকে কারফিউ। রাশেদ এল বিকাল বেলা। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, খবর আছে কিছু?
স্ত্রী।
কি খবর?
এম. পি সাহেবের বাসা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
এম. পি সাহেব কই?
আন্ডারগ্রাউন্ড। তাকে পায় নাই। জামাইকে পেয়েছে। গুলী করে মেরে ফেলেছে।
ডেডবডি পড়ে আছে এখনো।
ও।
শরীরে যখন গুলী লাগে বুলেটটা ঘুরতে ঘুরতে যায়।
তাই নাকি?
জী। সামনে থাকে একটা ছোট ফুটো— পিছনে বড় গর্ত হয়ে যায়। গুলীটা ঘুরে ঘুরে বের হয়তো, তাই।
আব্বা ঢোক গিলে বললেন, ও।
রাশেদ মাথা নাড়ল। জী, গুলীটো সীসা দিয়ে তৈরি হয়। যখন শরীরে লাগে তখন ফেটে যায়, সীসা তো নরম, তাই।
ও।
মিলিটারী সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শখানেক মানুষ মেরেছে। ধরেছে আরো শ’খানেক—
ও।
যাদের ধরেছে তাদেরকেও মারবে।
তুমি কেমন করে জান?
সবাইকে একটা কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে দিয়েছে। যার কবর সে নিজে কাটবে। কাটা হলে পাশে দাঁড়িয়ে গুলী।
তুমি কেমন করে জান?
দেখেছি। স্কুলের পাশে জংলা মতন জায়গা আছে, সেখান থেকে দেখা যায়।
আব্বা অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
তোর ভয় করে না?
করে। রাতে ঘুমাতে পারি না।
তাহলে?
রাশেদ চুপ করে বসে রইল। আব্বা নরম গলায় বললেন, বাসায় যাও রাশেদ, একটু পরে কারফিউ দেবে।
রাতে শুনলাম আব্বা নিচু গলায় আম্মাকে বলছেন, কোনদিন কল্পনা করেছি ইবুর বয়সী ছেলেরা এত সহজে মানুষকে মেরে ফেলার কথা বলবে। যেন ব্যাপারটা এত সহজ! ভেবেছিলে?
আম্মা কোন কথা বললেন না। আব্বা আবার বললেন, কেন এমন হল বল দেখি?
কেন?
আম্মা। তবু কিছু বললেন না।
খোদা তুমি কি করলে এই দেশটাকে? কি করলে?
আমি শুনলাম আম্মা নিচু গলায় কাঁদছেন। আমি আগে কখনো আম্মাকে কাঁদতে শুনিনি। দুঃখে আমার বুকটা ভেঙে যেতে লাগল।
০৭. শফিক ভাই মুক্তিবাহিনীতে
শফিক ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে গেলেন একদিন। কেউ অবিশ্যি সেটা জানল না, জানলে শফিক ভাইয়ের চাচার বড় বিপদ হতে পারে। সবাই জানল যে শফিক ভাইয়ের বাবার শরীর ভাল না, তাই বাড়ি গেছেন। আমি অবিশ্যি জেনে গেলাম। জানালাম অন্য কারণে।
আরু অ্যাপাকে অনেকদিন দেখি না। শহরে মিলিটারী আসার পর বাস্তাঘাটে কমন্বয়েসী মানুষ একেবারে বের হয় না। ছেলেরাও নয়, মেয়েরাও নয়। একদিন আম্মা আমাকে পাঠালেন অরু, আপাদের বাসায় ‘খাবনামা’ নামে একটা বই আনতে। কোন স্বপ্ন দেখার কি অর্থ সেই বইয়ে লেখা আছে। আম্মা কয়েক রাত থেকে কি একটা স্বপ্ন দেখছেন, সেটার কি অর্থ সেটা জানতে চান।