আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদব না। কাঁদব না করেও কাঁদতে শুরু করলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কিন্তু আমার ঠিক দুঃখ লাগছিল না। আমার কেমন জানি রাগ উঠছিল, ভয়ংকর রাগ। ভয়ংকর ভয়ংকর রাগ।
০৬. আমাদের শহরে মিলিটারী এল
আমাদের শহরে মিলিটারী এল এপ্রিল মাসের তিবিশ তারিখে। ততদিন শহর প্রায় খালি হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন বেশি নেই, দোকানপাট বন্ধ। একজন দুজন যারা আছে তাদের চোখে-মুখে কেমন জানি একটা ভয় ভয় ভাব। কেমন একটা সন্দেহ আর এক ধরনের আতংক।
আব্বার চেহারাতেও কেমন জানি দুশ্চিন্তার একটা ছাপ পড়ে গেছে। আমি যখন আশে-পাশে থাকি না তখন আম্মার সাথে নিচু গলায় কথা বলেন আর মাথা নাড়েন। মিলিটারী এলে কি হবে সেটা নিয়ে আব্বার মনে নানারকম দুশ্চিন্তা।
যেদিন মিলিটারী এল সেদিনটাও ছিল ঠিক অন্যদিনের মত। নীল আকাশ, পরিষ্কার একটি দিন, গরম বাতাস, শুকনো ধুলো উড়ছে চারদিকে। বেলা এগারোটার দিকে একটা গুজব ছড়িয়ে গেল মিলিটারীর গানবোট এসে থেমেছে। নদীর ঘাটে। হাজার হাজার মিলিটারী নামছে গানবোট থেকে, দৈত্যের মত একেকজনের চেহারা।
আমার একটু দেখার কৌতূহল হচ্ছিল, আব্বা গন্তীর গলায় বললেন, খবরদার, ঘর থেকে বের হবে না।
আমি তাই ঘর থেকে বের হলাম না, জানালার কাছে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাস্ত খালি, কোন মানুষজন নেই। একটা রিকশাও নেই কোথাও।
দুপুরবেলায় দেখলাম খান বাহাদুর দুইজন মানুষ নিয়ে সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা রিকশার জন্যে অপেক্ষা করলেন বলে মনে হল। কিন্তু আজ রিকশা পাবেন কোথায়? রিকশা না পেয়ে আবার তারা হাঁটতেই শুরু করলেন। দেখে মনে হয় নদীর ঘাটের দিকেই যাচ্ছেন। রাশেদ তাহলে সত্যি কথাই বলেছিল, একেবারে খাটি পাকিস্তানী দালাল। তবে আমার স্বীকার করতেই হল, খান বাহাদুরের সাহস আছে, দৈত্যের মতন চেহারার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে দেখা করতে বুকের পটা লাগে।
খানিকক্ষণ পর হঠাৎ গোলাগুলীর শব্দ শোনা গেল। অনেকদূর থেকে আসছে কিন্তু গোলাগুলীর শব্দ তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম আবার হঠাৎ করে থেমে গেল। তারপর আর কোন শব্দ নেই।
আব্বা দরজা-জানোলা বন্ধ করে দিলেন। আমরা ঘরের ভিতর চুপ করে বসে রইলাম। আব্বা পায়চারি করছেন, আম্মা চুপচাপ বসে আছেন, কারো মুখে কোন কথা নেই। আমার পেটের ভিতরে কেমন যেন পাক দিতে থাকে। এক এক মূহুৰ্ত মনে হয় এক এক ঘণ্টা।
বেলা তিনটার দিকে হঠাৎ দরজায় শব্দ হল। আব্বা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখেন, রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে বললেন, সে কি! তুমি এখানে কি করছ?
রাশেদ ভিতরে ঢুকে বলল, খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে।
আমি এক গ্লাস পানি এনে দিলাম। ঢাকাঢ়ক করে পুরো গ্লাস শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাইরে যা গরম!
আব্বা বললেন, এমন দিনে তুমি বাসা থেকে বের হলে কেন? বাসায় যাও তাড়াতাড়ি।
যাব।
তোমার বাসায় চিন্তা করবে না?
নাহ।
আব্বা অবাক হয়ে একবার রাশেদের দিকে তাকালেন, আরেকবার আমার দিকে তাকালেন। রাশেদ খানিকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মিলিটারীরা খান বাহাদুরকে মেরে ফেলেছে।
আব্বা ভয়ানাক চমকে উঠে বললেন, কি? কি বললে?
রাশেদ নিচের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, মিলিটারীবা খান বাহাদুরকে মেরে ফেলেছে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি।
আব্বা শুনে একেবারে লাফিয়ে উঠে বললেন, তুমি দেখেছ?
রাশেদ মাথা নাড়ল।
কোথায় দেখেছি?
আব্বা খানিকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলেন না। অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পর নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নদীর ঘাটে কি করতে গিয়েছিলে?
মিলিটারী দেখতে গিয়েছিলাম।
তুমি একা?
হ্যাঁ। সড়কের পাশে একটা নারকেল গাছ আছে, তার পিছনে লুকিয়েছিলাম।
তুমি নিজের চোখে দেখেছি খান বাহাদুরকে মেরে ফেলেছে?
হ্যাঁ। রাশেদ ফ্যাকাসে মুখে একবার আব্বার মুখের দিকে তাকল, আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোর ভয় করেনি?
করেছে।
কেমন করে মেরেছে?
গুলী করে। খান সাহেব দুইজন মানুষকে সাথে নিয়ে হেঁটে আসছিলেন, তখন রাস্তায় দুইটা মিলিটারী তাকে থামিয়েছে। খান সাহেবের সাথে কি সব কথাবার্তা বলেছে। তারপর যেই সামনে হেঁটে যেতে চেষ্টা করেছেন মিলিটারী দুইটা বন্দুক তুলে গুলী করতে শুরু করেছে। সাথের দুইজন উল্টো দিকে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করেছে, তখন তাদেরকেও গুলী করে মেরে ফেলেছে।
সাথে সাথে মরে গেছে সবাই?
সেটা জানি না। রাস্তায় তিনজনের লাশ পড়েছিল, মিলিটারীরা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে এনে ফেলে রেখেছে।
আব্বা ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করলেন, তু-তু-তুমি নিজের চোখে দেখেছি সব?
হ্যাঁ।
এইটুকুন ছেলে, তুমি নিজে এইসব দেখেছ?
রাশেদ আবার মাথা নাড়ল। আমি দেখলাম তার শরীর অলপ অলপ কঁপিছে। বলল, আমি কিছুক্ষণ এখানে বসি?
বস।
রাশেদ চুপচাপ বসে রইল। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন অন্যরকম। যেন কিছু একটা বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ বসে থেকে বিকেল বেলা সে চলে গেল।
মিলিটারীরা অনেক সময় নিয়ে নদীর ঘাট থেকে শহরের মাঝে এল। প্রথমে একদল হাতের বন্দুক তাক করে মাথা নিচু করে গুড়ি মেরে এগিয়ে আসে। খানিকদূর এগিয়ে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পজিশন নেয়, কন্দুক তাক করে শুয়ে বসে থাকে, তখন আরেক দল এগিয়ে আসে। কাছাকাছি আসার পর আরেকদল গুড়ি মেরে একটু এগিয়ে যায়, তারা পজিশান নেবার পর অন্যেরা আসে। দেখে—শুনে মনে হয় তারা কোন রকম ঝুঁকি নিচ্ছে না, হঠাৎ করে কেউ যদি আক্রমণ করে বসে তার জন্যে এত রকম ব্যবস্থা। নদীর ঘাট থেকে শোহরের মাঝখানে দুই মাইলের মতন, এইটুকু আসতে তাদের দুই ঘণ্টার মত লাগল। এই সময়টাতে ওরা চোখের সামনে যাকে দেখেছে তাকেই মেরে ফেলেছে। শুরু করেছে খান সাহেব। আর তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে, তারপর রাস্তায় আরো গোটা দশেক মানুষকে এভাবে মেরেছে। কেউ বাজার করতে যাচ্ছিল, কেউ মিলিটারী দেখে ভয়ে দৌড় দিয়েছিল। কেউ রাস্তায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, আবার কেউ শুধুমাত্র কৌতূহলী হয়ে গিয়েছিল মিলিটারী দেখার জন্য। মিলিটারীরা কাউকে ছেড়ে দেয়নি।