বড় বড় শহরগুলি পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে দখল করে নিয়েছে। আমাদের এই ছোট শহরটাতেও এসে যাবে যে কোন দিন। সবাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে। আম্মা একদিন আব্বাকে বললেন, শুনেছি, সবাই যে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে?
আব্বা কিছু বললেন না।
আমরাও কি যাব?
আব্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোথায় যাব আমরা?
দেশের বাড়ি?
আব্বা দুর্বলভাবে হেসে বললেন, এখন কি রাস্তাঘাট কিছু আছে, নাকি যাওয়ার কোন উপায় আছে? দেশের কি অবস্থা শুনিছ না?
একদিন অনেক রাতে দিলীপের বাবা আমাদের বাসায় এলেন। দিলীপের বাবা আব্বার সাথে একই কলেজে পড়ান, আমরা কাকু বলে ডাকি। দিলীপের বাবা এমনিতে দেখতে খুব সুন্দর, একবার যখন নাটক হয়েছিল। সিরাজদ্দৌলার অভিনয় করেছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল। সত্যিই বুঝি একজন রাজা! এখন অবিশ্যি তঁাকে দেখতে কেমন জানি লাগছে। চুল উশকো-খুশকো। মুখে খোচা খোচা দাড়ি, চোখ লাল, মনে হয় কতদিন ঘুমাননি। বাবাকে বললেন, আজীজ, কাল চলে যাচ্ছি।
আব্বা বললেন, সত্যি?
হ্যাঁ, যা খবর পাচ্ছি। আর থাকা যায় না।
আব্বা মাথা নাড়লেন। কাকু বললেন, কারো জীবনের আর কোন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু হিন্দু কিংবা আওয়ামী লীগের কেউ হলে তার আর কোন রক্ষা নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমন করে এত বড় বিপদের ঝুকি নেই?
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে যাবে?
এখান থেকে বাসে করে নদীর ঘাট পর্যন্ত যাব। সেখান থেকে নদী পার হয়ে বাকি পথ হেঁটে।
বর্ডার পর্যন্ত পৌছাতে কতদিন লাগবে?
ঠিক জানি না। এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন।
দশ দিন?
কাকু শুকনো মুখে বললেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কি যে হবে ভগবানই জানেন!
আব্বা বললেন, তুমি যাও, কে জানে তোমাদের পিছু পিছু হয়তো আমাদেরও আসতে হবে।
কাকু গলা নামিয়ে বললেন, কাউকে বলে যাচ্ছি না। শুধু তোমাকে বললাম। তুমি যদি পার বাড়িঘরের দিকে একটু চোখ রেখো।
কাকু আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, আমি চোখ রাখব? একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ধরে রাখলাম সব গেছে। প্রাণে বেঁচে থাকলেই আমি খুশি।
কাকু আব্বাকে কি সব কাগজপত্র দিয়ে যাবার সময় বাবাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কীদো কঁদো হয়ে গেলেন। ভাঙা গলায় বললেন, আমার ছেলেমেয়ের জন্যে একটু প্রার্থনা কর।
করব। তুমি খোদার উপর ভরসা রেখো। খোদা এত বড় অবিচার সহ্য করবে না।
কাকু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় আব্বা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কাল কখন রওনা দেবে?
ভোরে। খুব ভোরে।
ভেবেছিলাম খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিব। কিন্তু তবু দেরি হয়ে গেল— লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। দিলীপরা কি চলে গেছে। এর মধ্যে? আমি বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ না ধুয়েই জুটুলাম ওদের বাসার দিকে। যাবার আগে একবার দেখাও যদি না হয় তাহলে কেমন করে হবে?
গিয়ে দেখি ওরা এখনো চলে যায়নি। তবে সবাই বের হয়েছে, সাবার সামনে দুইটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, এক্ষুনি চলে যাবে। আমাকে দেখে দিলীপ ছুটে এল, তার চোখ লাল, শার্টের হাতা দিয়ে নাক-মুখ আর চোখ মুছে, বলল, আমরা বাস্তুহারা হয়ে যাচ্ছি।
বাস্তুহারা?
হ্যাঁ, যাদের ঘরবাড়ি নেই তাদের বাস্তুহারা বলে।
এই তো তোদের ঘরবাড়ি।
একটু পরে আর থাকবে না। রাস্তায় ঘুমাতে হবে। চিড়া খেয়ে থাকতে হবে।
চিড়া?
হ্যাঁ। শুধু চিড়া। দিলীপকে কেমন হতচ্ছড়িার মত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ফ্যাসফ্যাস করে আবার কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমি যেতে চাই না। আমি ইণ্ডিয়া যেতে চাই না।
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না, আমার চোখেও হঠাৎ পানি এসে গেল। দিলীপ কোন মতে কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল, যারা হিন্দু তাদের সবাইকে মিলিটারীরা মেরে ফেলছে। আমরা এখন কোথায় থাকব?
আমি বললাম, দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন আর কোন হিন্দু-মুসলমান থাকবে না।
ততদিনে আমরা মরে ভূত হয়ে যাব।
কেন মরবি? আমরা যে হিন্দু! রাস্তায় যদি আমাদের ধরে তাহলে বলব, আমরা মুসলমান। বাবা আমাদের সবার একটা করে নাম ঠিক করে দিয়েছে। মুসলমান নাম। আমারটা আমি নিজে ঠিক করেছি।
কি নাম?
রকিবুল হাসান।
আমি দিলীপের দিকে তাকলাম। রকিবুল হাসান আমার ভাল নাম। সবাই ইবু বলে ডাকে, তাই ভাল নামর্টার কথা মনেই থাকে না, দিলীপের মনে আছে।
দিলীপ হঠাৎ এসে আমাকে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার মরতে ইচ্ছা করে না। একেবারে মরতে ইচ্ছা করে না।
মরবি কেন? ছিঃ!
আমি জানি আমরা সবাই মরে যাব। সবাই। সবাইকে মেরে ফেলবে মিলিটারী। আমাদের সবাইকে মেরে তোদেরকেও মেরে ফেলবে। আমার মেশোমশাইকে মেরে ফেলেছে। সঞ্জয়দা ছিল তাকেও মেরে ফেলেছে। আমি জানি আমাদেরকেও মেরে ফেলবে।
দিলীপ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। দিলীপের বাবা এসে দিলীপের হাত ধরে নিয়ে গেলেন। কাকীমা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে। বুঝতে পারছি না কেন। দিলীপের বোন শিপ্রাদি আজ একটা শাড়ি পরেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর কেউ কোন কথা না বলে রিকশায় উঠলেন। তাদের হাতে বেশি কোন জিনিস নেই, ছোটখাট কয়েকটা ব্যাগ। পানির একটা বোতল। দিলীপ একটা বই শক্ত করে ধরে রেখেছে। কি বই এটা?
রাস্তা দিয়ে রিকশাটা চলে যাবার পর হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম কাকীমাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে কেন। কাকীমার কপালে কোন সিঁদুর নেই। দেখে যেন কেউ বুঝতে না পারে তারা হিন্দু।