স্বাধীন বাংলা হবে তাহলে সত্যি!
০৫. রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি
রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। দেখি সবাই রেডিওর সামনে মুখ কাল করে বসে আছে। রেডিওতে প্রথম ইয়াহিয়া খান বক্তৃতা দিল। ইংরেজিতে বক্তৃত। কিছু বুঝতে পারলাম না। আব্বা যেভাবে একটু পরে পরে মাথা নাড়তে লাগলেন মনে হল খুব খারাপ জিনিস বলছে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কি বুলছে গো?
বলছে সব দোষ শেখ মুজিবের। দেশটাকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিল, কোন মতে রক্ষা হয়েছে। তাকে এখন কঠিন শাস্তি দেবে।
শেখ মুজিব এখন কোথায় আছেন?
বলেছে তো এরোস্ট করেছে। সত্যি-মিথ্যা কে জানে।
আম্মা শুকনো মুখে বসে রইলেন। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতার পর রেডিওতে একজন ঘোষণা দেয়া শুরু করল। শহরে কারফিউ, বাইরে বের হলেই গুলী করা হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। রেডিওতে যারা কথা বলে তারা সব সময়ে খুব সুন্দর করে কথা বলে, কিন্তু এই লোকটাকে মনে হল কোন জঙ্গল থেকে ধরে এনেছে, উচ্চারণ এত খারাপ যে শুনলে বমি এসে যায়। আব্বা বিরক্ত হয়ে বললেন, বন্ধ করা তো রেডিওটা। বন্ধ করা।
আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম।
বাইরে এসে দেখি রাস্তায় লোকজন খুব বেশি নেই। যারা আছে তারা সবাই এখানে সেখানে রেডিও নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বি. বি. সি. রেডিও অস্ট্রেলিয়া শোনার চেষ্টা করছে। আমি ইংরেজি বুঝি না, তাই খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। একটু পর দেখলাম একটা মিছিল এল, অন্যদিন মিছিল যে রকম হেঁটে হেঁটে যায় আজ সে রকম নয়, একেবারে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। এটাকে বোধ হয় বলে জঙ্গী মিছিল। মিছিলের শেষের দিকে কমবয়সী ছেলেরা, তাদের হাতে রাইফেল, কোমরে গুলীর বেল্ট। এত তাড়াতাড়ি এই ছেলেগুলি বন্দুক রাইফেল কোথায় পেলা? সত্যি সত্যি তাহলে যুদ্ধ শুরু হবে এখন, যেটাকে গৃহযুদ্ধ বলে? উত্তেজনায় আমার বুক কাপতে থাকে।
সারাটা দিন কেমন করে কাটল টেরই পেলাম না। শুধু গুজব আর গুজব। কি হচ্ছে কেউ জানে না, একেক জন একেকটা গুজব নিয়ে আসে। একবার শুনি প্রচণ্ড যুদ্ধ, পাকিস্তানীরা প্রায় সারেন্ডার করে করে অবস্থা। আরেকবার শুনি ঢাকা শহর পাকিস্তানীরা দখল করে ফেলেছে, শহরে এখন লক্ষ লক্ষ মৃতদেহ। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা বোঝার কোন উপায় নেই। রেডিওতে কিছু বলে না, আকাশবাণী কোলকাতা থেকে শুধু ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাজিয়ে যাচ্ছে আর সব অনুষ্ঠান বন্ধ। মনে হয় বাইরের পৃথিবীও কিছু জানে না।
এভাবে কোন রকমে দিনটা কেটে গেল। রাতে আবার কিছু কিছু গুজব এল। কিছু ভাল কিছু খারাপ। কোনটা বিশ্বাস করা যায় বোঝা যাচ্ছিল না। রাত্রে বি. বি. সি. থেকে একজন বলল ঢাকায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা। ছাত্র শিক্ষক সাধারণ মানুষ যাকে পেয়েছে মেরে শেষ করেছে। সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
পরদিন বিকেলবেলা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। বিকেলের দিকে হঠাৎ চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন বলল, বঙ্গবন্ধু ভাল আছেন। তঁাকে নেতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। এখন স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে। আর কোন ভয় নেই।
শোনামাত্র সবাই আনন্দো চিৎকার করে উঠল। তার মানে পাকিস্তানীরা এক তরফ মারছে না। আমাদের সৈন্যরাও যুদ্ধ করছে। আমরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকি। কে জিতবে যুদ্ধে? কে?
মেজর জিয়াউর রহমান নামের মানুষটার জন্য গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল। বারবার সে বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছে। তাহলে পাকিস্তানীরা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় সবাইকে বলেছে কেমন করে যুদ্ধ করতে হয়। আর ভয় কি আমাদের!
একদিন দুই দিন করে এক সপ্তাহ কেটে গেল। আস্তে আস্তে সব খবর এসে পৌছাতে শুরু করেছে। প্রথম খবরটি সবচেয়ে খারাপ খবর, পাকিস্তানীরা আসলেই বঙ্গবন্ধুকে এরোস্ট করে নিয়ে গেছে। অন্য খবরগুলিও ভাল না। ঢাকায় পঁচিশে মার্চের রাতে নাকি হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে। যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেটা কমে এসেছে। ইয়াহিয়া খান আর ভুট্রো যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ-আলোচনার ভান করছিল আসলে তখন হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে নিয়ে এসেছে। তারপর খুব ভাবনা-চিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় আক্রমণ করেছে। বাঙালী সৈন্যদের কাছে অস্ত্র রাখতে দেয়নি, তাই ঢাকায় সবচেয়ে বড় যুদ্ধ করেছে পুলিশেরা, রাজারবাগে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ইণ্ডিয়াতে। পৃথিবীর সব দেশ পুরো ব্যাপারটা বেশ কৌতূহল নিয়ে লক্ষ্য করছে, কিন্তু কেউ পাকিস্তানীদের থামাতে এগিয়ে আসছে না। পাকিস্তানীরা চোখ বন্ধ করে দুই হাতে শুধু মানুষকে মেরে যাচ্ছে।
প্রথম দিকে আমাদের এই ছোট শহরটায় যে রকম টগবগে একটা উত্তেজনা ছিল এখন সেরকম উত্তেজনা নেই, তার বদলে সবার ভিতরে কেমন একটা ভয় এসে জায়গা নিচ্ছে। স্কুলে মুক্তি বাহিনীর একটা ট্রনিং সেন্টার খোলা হয়েছিল, ছেলেরা সেখানে ট্রেনিং নিত। ট্রেনিং সেন্টার উঠে গেল। যাঁরা নেতা ছিলেন, গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না। সবাই নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড চলে গেছেন। শহরে কোন পুলিশ নেই। একদিন দিনদুপুরে একটা মস্ত ডাকাতি হয়ে গেল। আমরা বাসায় বসে শুনতে পেলাম প্রচণ্ড গোলাগুলী হচ্ছে। সব মিলিয়ে পুরো শহরটায় কেমন যেন একটা আতংক আতংক স্বভাব।