- বইয়ের নামঃ আমার বন্ধু রাশেদ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই
০১. রাশেদ যেদিন প্রথম স্কুলে এসেছিল
রাশেদ যেদিন প্রথম স্কুলে এসেছিল সেটা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে, স্যার রোল কল করার জন্য খাতা খুলছেন ঠিক তখন দেখলাম এক্সটা ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তার বাম হাতে একটা কাগজ, সেটা ভিজে চুপচুপে, সাবধানে সে কাগজটা ধরে রেখে ক্লাসের ভিতরে উকি দিতে থাকে। দেখে মনে হয় তার ছাগলের বাচ্চটাচ্চা কিছু একটা হারিয়ে গেছে, সেটা খুঁজে দেখছে ক্লাসের ভিতরে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি একটা ভেবে শেষ পর্যন্ত সে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। মজিদ স্যার ভুরু কুচকে বললেন, এ্যাই, তুই কে রে? কি চাস?
সে কোন উত্তর না দিয়ে ভিজে কাগজটা স্যারের টেবিলে রেখে হাতটা প্যান্টে মুছে ফেলল। স্যার একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা?
কাগজ।
কাগজ তো দেখতেই পাচ্ছি। কি কাগজ?
জানি না। ছেলেটা উদাসমূখে সারা ক্লাসটাকে এক নজর দেখে বলল, অফিস থেকে দিয়েছে।
স্যার ভিজে কাগজটার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, ভর্তির কাগজ? তুই এই ক্লাসে ভর্তি হবি?
ছেলেটা আবার উদাসমুখ বলল, জানি না।
জানিস না মানে? স্যার ধমক দিয়ে বললেন, কাগজটা ভিজল কেমন করে?
নালায় পড়ে গিয়েছিল।
নালায়? স্কার ভুরু কুঁচকে হাত সরিয়ে নিলেন।
ময়লা নেই স্যার—ধুয়ে এনেছি।
ধুয়ে এনেছিস? স্যার চোখ গোল করে ছেলেটার দিকে তাকালেন। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি তোর?
লাড্ডু।
লাড্ডু?
শুনে আমরা পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠলাম। স্যার একটা রামধমক দিয়ে বললেন, চুপ কর। এক্কেবারে চুপ! আমরা চুপ করতেই মজিদ স্যার আবার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল নাম কি?
ভাল নাম নেই।
ভাল নাম নাই?
না।
তোর নাম শুধু লাড্ডু?
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
তার আগেও কিছু নাই পিছেও কিছু নাই?
নাহ।
স্যার আবার খানিকক্ষণ অবাক হয়ে লাড্ডুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, শুধু লাড্ডু কখনো কারো নাম হয়?
লাড্ডু চিন্তিতমুখে বলল, না।
তাহলে?
লাড্ডুর সাথে আর কিছু লাগিয়ে দেন তাহলে।
আর কিছু লাগিয়ে দেব?
কি লাগাব? মুহম্মদ? লাড্ডু মুহম্মদ?
ঠিক আছে। ছেলেটা রাজি হয়ে গেল।
স্যার খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভীষণ রেগে টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, কভি নেহী। আমার ক্লাসে কারো ভাল নাম লাড্ডু মুহম্মদ চলবে না। তোর বাবাকে গিয়ে কলবি একটা ভাল নাম দিতে।
ছেলেটা মাথা চুলকে বলল, লাভ নাই স্যার।
কেন লাভ নেই?
বাবা নাম দিবে না।
কেন দিবে না?
বড় আলসে। তা ছাড়া একটু পাগল কিসিমের। আমার এক ভাই আছে, তাকেও পুরা নাম দেয়নি।
কি নাম তার?
চমচম।
আমরা সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠতেই স্যার আবার একটা রামধমক দিলেন, চুপ, এক্কেবারে চুপ! না হয় মাথা ভেঙে ফেলব।
আমরা চুপ করার পর স্যার ছেলেটার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, তোর মা–
আমার মা নাই।
ও। স্যার হঠাৎ চুপ করে গেলেন। খানিকক্ষণ আঙুল দিয়ে টেবিলে শব্দ করলেন, তারপর বললেন, তাহলে আমি তোকে একটা ভাল নাম দিয়ে দিব?
ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, দেন স্যার।
মজিদ স্যার খানিকক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোর বাবাকে গিয়ে বলবি কাল তোর নতুন নাম দেয়া হবে।
ঠিক আছে।
স্যার তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল তোরা সবাই একটা করে সুন্দর নাম লিখে আনবি। মনে থাকবে তো?
আমরা মাথা নাড়লাম, মনে থাকবে।
স্যার চলে যাবার পর আমরা সবাই ছেলেটাকে বাজিয়ে দেখতে গেলাম। যখনই ক্লাসে নতুন ছেলে আসে তাকে সব সময় বাজিয়ে দেখতে হয়। কে জানে হয়তো এমন একজন ভাল ছাত্র আসবে যে সব সাবজেক্টে একশতে নব্বই-পচানব্বই পেয়ে আমাদের জীবন নষ্ট করে দেবে— আশরাফ যেরকম করেছে। কিংবা কে জানে হয়তো বাবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, কোন কারণে তাকে ধোলাই দিলে তার বাবা পুলিশ পাঠিয়ে আমাদের ধরিয়ে নিয়ে যাবে- মাসুমের বাবা যেরকম করেছিল। কিংবা কে জানে হয়তো এমন বদমাশ বের হবে যে আমাদের সবার জান একেবারে ভাজা ভাজা করে খেয়ে ফেলবে— কাদের যেরকম করেছে। আগে থেকে কিছু বলা যায় না। তাই ছেলেটাকে সবসময় বাজিয়ে দেখা দরকার।
আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কি পরীক্ষায় ফাস্ট হবি?
ছেলেটা মুখ বাকা করে বলল, মাথা খারাপ হয়েছে তোর?
কি হবি তাহলে?
ফেল করব। সব সাবজেক্ট ফেল।
সব সাবজেক্টে?
হ্যাঁ।
দিলীপ চিন্তিতমুখে বলল, কেমন করে জানিস আগে থেকে?
না জানার কি আছে? স্কুলে এলাম কেন আমি?
ফেল করার জন্যে?
হ্যাঁ। দুই বছর পর পর ফেল করলে আর পড়াশোনা করতে হবে না। বাবা বলেছে।
ফজলু চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কখনো পড়াশোনা করতে হবে না?
না!
আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকলাম। ফজলুর চোখ হিংসায় ছোট ছােট হয়ে এল, বলল, ফেল করলে তোর বাবা তোকে বানাবে না?
ছেলেটা খিকখিক করে হেসে বলল, আমার বাবা কখনো বানায় না। পাগল কিসিমের মানুষ তো !
কি করে?
গল্পগুজব করে। আলাপ-আলোচনা করে।
তোর সাথে?
হুঁ।
কি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে?
বেশির ভাগ রাজনৈতিক আলোচনা।
রাজনৈতিক আলোচনা ! আমরা একেবারে হা হয়ে গেলাম। বলে কি এই ছেলে ! তার বাবা তার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে !