২
ইতিহাস সীমাবদ্ধ দেশে খণ্ডকালের ইতিহাস। কিন্তু সে সীমার মধ্যে ওই নির্দিষ্ট কালে যত মানবীয় ঘটনা ঘটে, যে ঘটনা মানুষ নিজে ঘটায় বা যা মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে, তার কণামাত্রই ইতিহাসের উপাদান। সে ইতিহাস যে বিষয়ের হোক, যত বিস্তৃত যত ঘটনাবহুল হোক।
অশোক মগধের সিংহাসনে বসলেন পিতার উত্তরাধিকারে। পিতামহ ও পিতার যুদ্ধার্জিত বিশাল সাম্রাজ্যের চক্রবর্তী-সম্রাট হলেন। সে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি দক্ষিণে কিছু বাদে প্ৰায় সমস্ত ভারতবর্ষ, এবং ভারতবর্ষের সীমা ছাডিয়ে উত্তর-পশ্চিমে গান্ধার দেশ, হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত— যুদ্ধ ও দেশরক্ষার বিজ্ঞানসম্মত, সায়েন্টিফিক ফ্রন্টিয়ার–ব্রিটিশ ভারত-সাম্রাজ্যে যার অভাবে সাম্রাজ্য-গবী লাট কার্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। এই বিস্তীর্ণ রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রু ও অন্তর্বিদ্রোহ থেকে রক্ষার জন্য অশোককে কোনও নুতন যন্ত্র তৈরি করতে হয়নি–পিতামহ ও পিতার গড়া হস্তাশ্বরথাপদাতির যুদ্ধনিপুণ বিরাট স্থায়ী বাহিনী প্রস্তুত ছিল। রাষ্ট্রের শাসন ও শাস্তির জন্য কোনও নূতন ব্যবস্থা অশোক প্রবর্তন করেননি। পিতৃপিতামহ-প্রবর্তিত নানা শ্রেণির রাজামাত্য, তাদের সংঘ ও সংহতি, সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল—এ কালের ভাষায় extensive bureaucratic organization. সৈন্য অমাত্য লোক ও বাণিজ্য-চলাচলের রাজপথ সাম্রাজ্যের এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত ছিল। এই রাজ্যের শাসনে ও ভোগে অশোকের রাজত্বের সাত বৎসর অতীত হল, অশনে বসনে, রাজকীয় আড়ম্বরে মগধের পূর্ব পূর্ব সম্রাটদের মতো। বঙ্গোপসাগরের তীরে কলিঙ্গরাজ্য উত্তরাপথে অশোকের সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল। পিতামহ কি পিতা সে রাজ্য জয় করেননি। সম্ভব তাঁদের অনুসরণে অশোক কলিঙ্গরাজ্য আক্রমণ করলেন, রাজ্যের সীমা বাড়াতে শক্তিমান রাজারা যা সচরাচর করে থাকেন—‘পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা’। কলিঙ্গ জয় হল। যুদ্ধে বহু লোক হত্য হল, বহু লোক বন্দি হল, বিজিত দেশের লোকেরা বহু দুঃখদুর্দশা ভোগ করল, এরকম যুদ্ধে যা স্বাভাবিক, সব সময় ঘটে থাকে। কিন্তু অশোকের মনের উপর তার ফল হল, যা যুদ্ধজয়ী রাজার মনে সচরাচর হয় না। পররাজ্যজয়ের নৃশংসতায় অশোকের মনে অনুশোচনা এল। সাময়িক অনুতাপের বিলাস নয়; সম্রাটের জীবনের গতি-পরিবর্তন হল। রাজ্যশাসনের লক্ষ্য বদলে গেল। অশোকের প্ৰতীতি হল, রাজার রাজ্যজয় বড় জয় নয়, বড় জয় আত্মজয়। সে আত্মজয়ের উপায় যে শীলাচরণ গৌতমবুদ্ধের উপদেশে দেশে সুজ্ঞাত ছিল অশোক নিজের জীবনে তার অনুশীলন আরম্ভ করলেন। তাঁর দৃঢ়নিশ্চয় হল, রাজার রাজ্যশাসন প্রজার কেবল বৈষয়িক সুখসমৃদ্ধির চেষ্টায় সফল নয়, রাজার বড় কর্তব্য প্রজাদের জীবন তাঁর নিজের জীবনের মতো এই শীলের নীতিতে গড়ে তোলা। অশোক সাম্রাজ্যময় এই শীলের প্রচারের এবং প্রজাদের জীবনে শীল রক্ষা করে চলার ব্যবস্থা করলেন। সম্ভব যে বুরোক্রেসি সমস্ত সাম্রাজ্যে রাজ্যশাসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই বুরোক্রেসি হল এই প্রচার ও রক্ষা-ব্যবস্থার প্রধান যন্ত্র। সুতরাং নীতিপ্রচারের পিছনে রাষ্ট্রশক্তির চাপ নিশ্চয় ছিল। রাজার উচিত কি না। প্ৰজার ব্যক্তিগত চরিত্র ও জীবন নিয়মিত করার চেষ্টা নিজের আদর্শ অনুসারে, তার ফল শেষ পর্যন্ত ভাল কি মন্দ, খুব তর্কের বিষয়। যেমন তর্কের বিষয়, অশোকের রাজশক্তির চেয়ে বহুগুণ ক্ষমতাশালী বর্তমানের রাষ্ট্রের উচিত কি না প্ৰজার জীবনকে নানা দিক থেকে নিয়মিত, কন্ডিশনড়, করার চেষ্টা, তার ফল শেষ পর্যন্ত ভাল না মন্দ। অশোক জীবনযাত্রার আদর্শের উপদেশ সাম্রাজ্যময় স্থায়ী রূপ দিয়ে লিখে দিলেন পাহাড়ের গায়ে, আশ্চৰ্যগড়ন পাথরের স্তম্ভে। গৌতমবুদ্ধের সদ্ধর্মের উপদেশ তিনি জানলেন নিখিল মানবের হিতের জন্য। সুতরাং কেবল নিজের প্রজাদের মধ্যে তার প্রচারে অশোক তৃপ্ত থাকতে পারলেন না। ভারতবর্ষে তার নিজের রাজত্ব-সীমার বাইরে এবং ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে অন্য সভ্যতার মানুষের নানা রাজ্যে তিনি প্রচারক পাঠালেন। ভারতবর্ষের সভ্যতা ও চিন্তাধারার সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগস্থাপন আরম্ভ হল। দু’হাজার বছরের বেশি হয়ে গেছে, তার ফল ও প্রভাব পৃথিবী থেকে মুছে যায়নি।
এক রাজার রাজত্বের চল্লিশ বছরের ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসে তার জুড়ি পাওয়া কঠিন।
এই চল্লিশ বছরে অশোকের রাজ্যে লক্ষ লক্ষ শিশু জন্মেছে, লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের জীবনে এবং জীবনের প্রতিদিন ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ লক্ষ চাষি দিনের পর দিন মাটি চাষ করে শস্য ফলিয়েছে, লক্ষ লক্ষ কুমোর কামার ও শিল্পী নানা শিল্পদ্রব্য গড়েছে। লক্ষ লক্ষ বিদ্যাশিক্ষার্থী ছাত্র বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছে। শিক্ষকেরা তাদের পড়িয়েছে। পণ্ডিতেরা জ্ঞানচর্চা করেছে। কবিরা কাব্য রচনা করেছে। দুঃখসুখে অগণিত লোকের প্রতিদিন জীবন কেটেছে। অশোকের রাজত্বের ইতিহাসে এসব লক্ষকোটি ঘটনার স্থান নেই। এ চল্লিশ বছরের মানবীয় ঘটনার তুচ্ছতিতম ক্ষুদ্র অংশ বেছে নিয়েই। তবে অশোকের রাজত্বের ইতিহাস রচনা সম্ভব। যদি অশোকের কালে তাঁর রাজ্যের প্রজাদের জীবনযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ জানা সম্ভব হত, যেমন জানা যায় বর্তমান কালের কোনও রাষ্ট্রের প্রজাদের; যদি প্রজাদের আর্থিক অবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব-আনন্দ, শিক্ষার প্রসার, শিল্প ও সাহিত্য-সৃষ্টি, সভ্যতার নানা ক্ষেত্রে তাদের গতি ও উন্নতির পূর্ণ ও যথার্থ খবর পাওয়া যেত, দু’পুরুষ পূর্বেকার বিদেশি আগস্তুকের খণ্ড বিবরণের ছিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করতে না হত; এবং অশোকলিপির কথাবস্তু, ও সাম্রাজ্যের সব অংশে সে অনুশাসন পাথরে খুদে প্রজাসাধারণের পড়ার জন্য ছড়িয়ে রাখার তথ্য, লিপির অক্ষরের সুডৌল, লিপিবাহী স্তম্ভের বিস্ময়কর সুঠাম ও মসৃণতা, পশুলাঞ্ছন স্তম্ভশীর্ষের আশ্চৰ্য কারিগরিএসব থেকে একটা মোটামুটি অনুমানের উপর নির্ভর করতে না হত, তবে অশোকের রাজত্বকালের ইতিহাস-লেখককে রাষ্ট্রীয় ও রাজার কর্মানুষ্ঠানের বিবরণ মাত্র দিয়েই ইতিহাস লিখতে হত না; সে কালের আর্থিক সামাজিক ও সভ্যতার ইতিহাস, প্রচলিত ইংরেজি সংজ্ঞায় যাকে বলে economical, social ও cultural history, সব মিলিয়ে অশোকের রাজত্বের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখতে পারতেন। কিন্তু যেসব লক্ষ লক্ষ ঘটনা। এ সামাজিক ইতিহাসের ভিত্তি, সে ইতিহাস লেখা সম্ভব হত এসব ঘটনার প্রতিটির বিশেষত্ব অর্থাৎ ঘটনাত্ব বর্জন করে, তা থেকে সাধারণ তথ্য ও তত্ত্ব নিষ্কাশন করে। সে কালের নিখিল ঘটনার সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনার পরিমাণের কোনও পরিমাণগত তুলনা থাকত না।