বেণো বিনষ্ট্যোহবিনয়ান্নাহুষশ্চৈব পার্থিবঃ।
সুদাস-যাবনিশ্চৈব সুমুখো নিমিরেব চ।
পৃথুস্ত বিনয়াদ্রাজ্যং প্রাপ্তবান মনুরেব চ। আদি, ৭।৷ ৪১-৪২
মেধাতিথি খুব সংক্ষেপে ভাষ্য করেছেন, ‘এতানি মহাভারতাদাখ্যাননি জ্ঞেয়ানি’। এবং মহাভারতেই তার উপদেশের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা আছে। ‘এতে চার বেদেরই কথা আছে, এ কাহিনি পবিত্র ও পাপভয়হারী’।
বেদৈশ্চতুভিঃ সংযুক্তং ব্যাসস্যাস্তুতকৰ্মণঃ।
সংহিতাং শ্রোতুমিচ্ছামঃ পুণ্যাং পাপভয়াপহাম।। আদি, ১। ২১
নৈমিষারণ্যের ঋষিরা সৌতির কাছে সোপাখ্যান লক্ষশ্লোকের ‘শ্রাব্যং ভারতমুত্তমম’ শুনতে চেয়েছিলেন।।
৫
মহাভারতের কাহিনি থেকে নানা উপদেশ-সংগ্ৰহ কিছুই কঠিন নয়। মানুষের অনেক কর্মচেষ্টা ও তার পরিণতি থেকেও কঠিন নয়। কিন্তু মহাভারতের দীর্ঘ ও বিচিত্র ইতিহাসের রচনা হয়েছিল গুটিকয়েক উপদেশের উদাহরণ-স্বরূপে–ওই উপদেশই লক্ষ্য, কাহিনির বর্ণনাটা উপলক্ষ–এমন কল্পনা সুস্থ মনের কল্পনা নয়। কোনও তত্ত্বের মায়ায় বুদ্ধির বিভ্রান্তি না ঘটলে সৰ্পে এমন রজ্জ্বভ্রম হয় না। নৈমিষাবণ্যবাসী তপস্বীরা মহাভারত-কথা শোনার জন্য সৌতিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ সে কথা বিচিত্র—‘চিত্ৰাঃ কথাঃ’।
তমাশ্রমমনুপ্রাপ্তং নৈমিষ্যারণ্যবাসিনঃ।
চিত্ৰাঃ শ্রোতুং কথাস্তত্র পবিবাবুস্তপস্বিনঃ ॥ আদি, ১।৩
যে কাহিনি বিচিত্র, গতানুগতিক সাধারণ ঘটনা নয়, তা মানুষের মনে গভীর দাগ কাটে। মানুষ সে কাহিনি ভুলতে চায় না। তাকে রচনায় নিবদ্ধ করে স্থায়ী করে রাখতে চায়। উপদেশের চিরকালীন ভাণ্ডবোধে নয়, অসাধারণ বিচিত্ৰকে স্থায়িত্ব দেবার মনের স্বাভাবিক প্রবণতায়। ‘প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং’। কিন্তু সমাজের হিতে যাঁরা অনন্যচিত্ত তাঁরা একে উপদেশের পুণ্যজলে শোধন করে মানুষের কাজে লাগাতে চান। ঐতিহাসিক কাহিনি যে কাহিনিমাত্র নয়, সংসারের যাত্রাপথে অঙ্গুলিসংকেত, সে শিক্ষা তাঁরা ইতিহাসের কাহিনি থেকে নিষ্কাশিত্ব করেন— সহজে বা কষ্ট। সমাজহিতৈষীদের প্রবৃত্তি-রেষা’। ঐতিহাসিক বলেন, ‘তথাস্তু। ভেবেছিলাম অতীত নিয়ে খেলা করছি, কিন্তু দেখি সমাজের হিত করছি। মনে করেছিলাম, প্রাচীন কাহিনি-তৃষ্ণার জল এনেছি, কিন্তু দেখছি যা এনেছি তা উপদেশের অমৃত। ধন্যোহহং।’
৬
বর্তমানে আমরা যাকে বলি যথার্থ ইতিহাস’ (real history), হোমারের ট্রয়-যুদ্ধের কি বেদব্যাসের ভারতযুদ্ধের ইতিহাসের মতো ইতিহাস নয়, তার লেখকেরাও অনেকে বলেছেন যে, তাঁরা ইতিহাস লিখেছেন কেবল অতীতের কাহিনিকে বর্ণনার জন্য নয়, যাতে অতীতের কাহিনির আলোতে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পথ-বিপথ চেনা যায়। সেই উদ্দেশ্যে। থুকিডডেস পেলপনেসিয়ান যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলেন, যাতে সেই অতীত ঘটনা থেকে এর পর অনুরূপ ঘটনার ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা যায়। পলিবিয়াস রোম-কার্থেজ যুদ্ধের ইতিহাসে ঘটনার কার্যকরণ-সম্বন্ধের অনুসন্ধান করেছেন, যাতে ভবিষ্যতের সদৃশ ঘটনায় এ সম্বন্ধের প্রয়োগ করা যায়। ইউরোপের কেবল গ্রিক কি গ্রিকো-রোমান যুগে নয়, তখন থেকে আজ পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ইতিহাসের এই রূপই কল্পনা করেছেন। ইতিহাস লোকশিক্ষক–ন্যায়াপথের শিক্ষা দেয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জ্ঞানের সে পরামর্শদাতা। এই কল্পনাকে মৃদু উপহাস করে র্যাঙ্কে তাঁর বিশ্ব-ইতিহাসের গোড়ায় বলেছেন, ‘ইতিহাসের উপরে যে কর্তব্য ন্যস্ত করা হয়, অতীতকে যাচাই করে বর্তমানকে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া, সে গুরুভার-বহনে তিনি অক্ষম। তিনি কেবল এইটুকু মাত্র দেখাতে চেষ্টা করতে পারেন যে, যা ঘটেছে তা ঠিক কেমন করে ঘটেছে।’
শাস্ত্ৰকৃৎ কি দার্শনিকেরা যে কারণে ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং ঐতিহাসিককে উপদেষ্টার আসনে বসিয়েছেন সে সম্মান বহু ঐতিহাসিক লিওপোলডু র্যাঙ্কের মতো প্রত্যাখ্যান করেননি। সে মৰ্যাদা ও সম্মান শিরোধাৰ্য করেছেন এবং নিজেদের কাজ সম্বন্ধে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু যদি বাইরের দেওয়া পদবির মোহ থেকে মুক্ত হয়ে ঐতিহাসিকেরা তাদের নিজের কাজ পরীক্ষা করে দেখেন ‘কিমিদং’ তবে ইতিহাসের স্বরূপ ও লক্ষ্যের যথার্থ জ্ঞান, বৌদ্ধেরা যাকে বলেন, ‘সম্যক জ্ঞান’, তা লাভ হয়।
থুকিডডেস তাঁর ইতিহাসের গ্রন্থ এই বলে আরম্ভ করেছেন :
‘এথেন্সবাসী থুকিডডেস পেলপনেসিয়ান ও এথেনিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধের ইতিহাস সংকলন করেছেন। যুদ্ধের সূচনাতেই তিনি লিখতে আরম্ভ করেন এই ধারণায় যে, পূর্বে পূর্বে যা সব ঘটেছে। এ যুদ্ধের গুরুত্ব তাদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি দেখলেন, সমস্ত গ্রিস দেশ এই যুদ্ধে এক পক্ষে নয় অন্য পক্ষে যোগ দিয়েছে বা দেবার জন্য প্ৰস্তুত হয়েছে, এবং অনেক অ-গ্রিকেরাও যোগ দিচ্ছে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীর অধিকাংশ লোক এই যুদ্ধের ব্যাপারে লিপ্ত হবে। অতীতের, বিশেষ দূর-অতীতের, কথা কালের ব্যবধানে সম্পূর্ণ জানা যায় না। কিন্তু অনুসন্ধান ও গবেষণায় যতদূর জানতে পেরেছেন তাতে মনে হয় না যে অতীতের কোনও যুদ্ধ বা ঘটনার এই যুদ্ধের মতো গুরুত্ব ছিল।’
পরবর্তী আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে থুকিডডেসের পেলপিনেসিয়ান-যুদ্ধের গুরুত্ব ও ব্যাপকত্বের ধারণা অতিমাত্রায় মাত্রাজ্ঞানহীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। যেমন এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, শেষ পর্যন্ত ও যুদ্ধটা ছিল একটা মাঝারি রকমের ঝগড়া; ওর স্মৃতি একটু বেশি টিকে আছে এইজন্য যে, থুকিডডেস তার ইতিহাস রচনা করেছিলেন। থুকিডডেসের ধারণায় বিজ্ঞতার হাসি হাসার পূর্বে মনে করা ভাল যে, যেসব ঘটনা ও ব্যাপারের গুরুত্বে ও ব্যাপকত্বে আকৃষ্ট হয়ে বর্তমানের ঐতিহাসিকেবা ইতিহাস লিখছেন, আড়াই হাজার বছর পরে সেসব ঘটনা ও ব্যাপারে তাদের ধারণা লোকে কী চোখে দেখবে–অবশ্য যদি ততদিন তার স্মৃতি বেঁচে থাকে।