দ্বৌ লোকে ধৃতব্ৰতৌ রাজা ব্ৰাহ্মণশ্চ বহুশ্রুতঃ।। ৮১
স এষ বহুশ্রুতো ভবতি।
লোকবেদবেদাঙ্গবিৎ।
বাকোবাক্যেতিহাসপুরাণকুশলঃ ॥ ৮॥৪-৬
বাকোবাক্য নামে বিদ্যাটির উল্লেখ যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির বচনেও আছে–টীকাকাররা ব্যাখ্যায় বলেছেন প্রশ্নোত্তর-রূপ বিদ্যা, সম্ভব তৰ্কশাস্ত্র, গ্রিসে Socratic dialogue-এ যার আরম্ভ।
যে-সকল প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রের পুথি টিকে আছে বা এ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে, গৌতমধৰ্মসূত্র তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এর যেসব প্রসঙ্গ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে এক তাদের মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে, গৌতমধর্মসূত্রের ব্যবস্থা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের চেয়ে প্রাচীনতর কালের ব্যবস্থা। পণ্ডিতপ্ৰবর কানে তার ‘ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন যে, গৌতমধর্মসূত্রের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ছয়শো থেকে চারশে শতকের পরে নয়। এ মত গ্রহণযোগ্য।
অর্থাৎ অন্তত আড়াই হাজার বছর পূর্বে থেকেই আমাদের দেশে ইতিহাস নামে বিদ্যার সৃষ্টি হয়েছিল ও চর্চা চলেছিল। এ বিদ্যার স্বরূপ কী ছিল?
৩
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ইতিহাসের মধ্যে ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্রের গণনা স্পষ্টই পারিভাষিক ব্যাপার। ওর মূল অপারিভাষিক অর্থ, অন্য যেসব বিদ্যার নাম করা হয়েছে তাদের সমষ্টিপুরাতনকালের বৃত্তান্ত, আখ্যায়িকা ও তাদের মধ্যে যে উপদেশ নিহিত আছে, যেসব ঘটনার উদাহরণ তাদের দৃঢ় করে। এরকম উদাহরণের বেশ একটু চমকপ্ৰদ নমুনা কৌটিল্য থেকে উদ্ধার করা যেতে পারে।
কৌটিল্য রাজাকে বাইরের ও ঘরের নানা শত্রু থেকে আত্মরক্ষায় সাবধানতার উপদেশ করেছেন। তার মধ্যে একটি উপদেশ এই: অন্তঃপুরে মহিষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে রাজা পূর্বে পরিচারিকাকে দিয়ে অনুসন্ধান নেবেন যে বিপদের কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা এবং এমন পরিচারিকাকে সঙ্গে না নিয়ে একাকী যাবেন না, কারণ
দেবীগৃহে লীনো হি ভ্ৰাতা ভদ্রসেনং জঘন।।
মাতুঃশয্যান্তর্গতশ্চ পুত্ৰঃ কারূশম।
লাজান্মধুনেতি বিষেণ পর্যস্য দেবী কাশিরাজম।
বিষদিগ্ধোন নূপুরেণ বৈরন্ত্যং মেখলামণিনাং সৌবীরং।
জালুথমাদর্শেন বেণ্যাগঢ়ং শস্ত্ৰং কৃত্বা দেবী
বিদূরথং জঘন।। ১॥১৭
পট্টমহিষীর ঘরে লুকিয়ে থেকে রাজা ভদ্রসেনকে তার ভাই হত্যা করেছিল। মা’র শয্যার তলে প্রচ্ছন্ন থেকে কারূশ-রাজাকে তার ছেলে হত্যা করেছিল। মধুর ছলে খই-এ বিষ মেখে কাশিরাজের মহিষী তাকে হত্যা করেছিল। বিষদিগ্ধ নুপুরের আঘাতে বৈরন্ত্য-রাজাকে, হত্যা করেছিল। বেণীতে অস্ত্ৰ লুকিয়ে রেখে বিদূরথ-রাজার মহিষী বিদূরথকে হত্যা করেছিল।
সন্দেহ নেই যে, কৌটিল্য প্রকৃত ঐতিহাসিক বৃত্তান্তবোধেই উদাহরণগুলির উল্লেখ করেছেন, কল্পিত আখ্যায়িকার নয়। সে ইতিহাসের মূলে তথ্যের সঙ্গে কিংবদন্তির যতই মিশ্রণ থাক। অজ্ঞাতি-অতীরের ভদ্রসেন-বিদূরথের হত্যা থেকে হাল-আমলের ‘লিকুইডেশন’ পর্যন্ত ক্ষমতালোভী মানুষের ছল ও নিষ্ঠুরতার পরিবর্তন হয়নি।
8
মনুস্মৃতির যে শ্লোকে ‘ইতিহাসাংশ্চ’ বলে বহুবচনে ইতিহাসের উল্লেখ আছে তার ভাষ্যে মেধাতিথি লিখেছেন, ‘ইতিহাস মহাভারতাদয়ঃ’। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির ইতিহাসিাংস্তথা’র ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানেশ্বর মিতাক্ষরায় ওই এক কথাই বলেছেন, ‘ইতিহাসান্মহাভারতাব্দীন। মেধাতিথি ও বিজ্ঞানেশ্বর মনুর তুলনায় অনেক আধুনিক। মেধাতিথি খ্রিস্টীয় অষ্টম কি নবম শতকের, বিজ্ঞানেশ্বর দশম কি একাদশ শতকের লোক। কিন্তু ইতিহাস যে মহাভারতের মতো গ্ৰন্থ এ ঐতিহ্য প্রাচীন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অথর্ববেদের সঙ্গে ইতিহাসকে বেদ বলা ও মহাভারত যে পঞ্চম বেদ এই প্রচলিত ধারণা, সম্ভব তার প্রমাণ। মনুস্মৃতির কোথাও নাম করে মহাভারতের উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন যে, মনুস্মৃতির বর্তমান আকারে রচনার সময় বর্তমান আকারের মহাভারতের রচনা হয়নি। কিন্তু মহাভারতের মূল কাহিনী অবশ্য অনেক প্রাচীন; এবং সে কাহিনি নিয়ে অনেক রচনা, অনেক গাথিকার নিশ্চয় সৃষ্টি হয়েছিল। মহাভারতের আদিপর্বের প্রথম অধ্যায়েই সে স্বীকৃতি রয়েছে। সৌতি বলছেন, অদ্ভুতকর্ম ব্যাসের যে রচনা তিনি শোনাতে যাচ্ছেন–
আচখুঃ কবয়ঃ কোচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পারে।
আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি।। (আদি, ১।২৬)
সে ইতিহাস কোনও কোনও কবি পূর্বে আংশিক বলেছেন, অপর কবিরা বর্তমানে বলছেন এবং অন্য কবিরা ভবিষ্যতে বলবেন। এবং সে ইতিহাসের সঙ্গে যে অনেক কল্পিত উপাখ্যানের মিশ্রণ ঘটেছে, সে কথা মহাভারতে স্পষ্ট করেই বলা আছে। উপাখ্যান নিয়ে মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষ। কিন্তু উপাখ্যান বাদ দিয়ে যে চব্বিশ হাজার শ্লোকে বেদব্যাস ভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন পণ্ডিতেরা তাকেই বলেন প্রকৃত মহাভারত।
ইদং শতসহস্ৰস্তু শ্লোকানাং পুণ্যকৰ্মণাম।
উপাখ্যানৈঃ সহ জ্ঞেয়ং শ্রাব্যং ভারতমুত্তমম।
চতুৰ্বিংশতিসাহস্ৰীং চক্ৰে ভারতসংহিতাম।
উপাখ্যানৈর্বিনা তা বঙারতং প্রোচ্যতে বুধৈঃ ॥ (আদি, ১।৬৩-৬৪)
অনুমান করা কঠিন নয় যে, লক্ষকে কেটে নয়, চব্বিশ হাজারকে বাড়িয়েই লক্ষ করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রচনাটিই মূল ভারতেতিহাস। সে কাহিনি যে ঐতিহাসিক, প্রাচীনকালে সত্য সত্যই ঘটেছিল, প্রাচীনদের এ বিশ্বাস দৃঢ়। আখ্যায়িকা ও পুরাণ থেকে তাঁরা মহাভারতের কাহিনিকে ভিন্ন করে দেখেছেন। পুরাণের কথায় মেধাতিথি বলেছেন, ‘পুরাণানি ব্যাসাদিপ্রণীতানি সৃষ্ট্যাদিবর্ণনরূপাণি’, অর্থাৎ যার বেশির ভাগ কল্পনা। আমাদের দেশের প্রাচীনেরা মহাভারতের কাহিনিকে ঐতিহাসিক মনে করেছেন, যেমন থুকিডিডের হোমার-বর্ণিত ট্রোজান-যুদ্ধকে ঐতিহাসিক মনে করেছেন। তবে মহাভারতের কাহিনিও যে উপদেশাত্মক, শাস্ত্রকারেরা সে কথা বলতে ভোলেননি। মনুস্মৃতির সপ্তম অধ্যায়ে বিনয়ের সুফল ও অবিনয়ের কুফল বর্ণনা আছে। জ্ঞানবৃদ্ধদের উপদেশে চলার নাম বিনয়, তাকে অগ্রাহ্য করা অবিনয়। অবিনয়ের ফলে রাজারা সপরিগ্রহ বিনষ্ট হয়, আর বিনয়ের গুণে কৌশহীন বনবাসীও রাজ্যলাভ করে। উদাহরণ,