খবরের কাগজের সঙ্গে ইতিহাসের নাম একসঙ্গে উচ্চারণে ঐতিহাসিকের বিরক্তির কারণ তার চেষ্টা ও সৃষ্টিকে খেলো করে দেখাতে। যে বিচারবুদ্ধি ও মননশক্তি, সত্যসন্ধিৎসা ও বস্তুনিষ্ঠ কল্পনা ইতিহাস-রচনায় প্রয়োজন তার তুলনা বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানকর্মের সঙ্গে। সেখানে খবরের কাগজের রিপোর্টার ও সম্পাদকীয় স্তম্ভের পেশাদার লেখকদের কথা তোলা বিকৃতরুচি রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকের উচ্চাঙ্গ মানসিক চেষ্টাকে খাটো করে দেখাই ইতিহাসকে হেয় করার মুখ্য কথা নয়। বড় কথা ইতিহাসের লক্ষ্যকেই ছোট করে ফেলা। মনের নানা খেয়ালখুশির চরিতার্থতায় মানুষ অনেক রকম সৃষ্টি কবেছে। রাজারাজড়া এবং বীরপুরুষেরা প্রাচীন বীরত্বের কাহিনি শুনতে চেয়েছে। চারণেরা কিংবদন্তি ও কল্পনায় মিশিয়ে গাথা রচনা করে রাজসভা ও বীরসভায় গান করেছে। মানুষ সাধারণ ও অসাধারণ মানুষকে নিয়ে হাসি-কান্না উপহাস-পরিহাসের কথায় মশগুল হয়। তাই কথাসরিৎসাগরের মতো বই দেশে দেশে লেখকেরা লেখে। মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে। পড়তে-লিখতে-জানা আধুনিক পৃথিবী গল্প-উপন্যাসে ছেয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাস এসব মনোরঞ্জকদের দলে নয়। তার লক্ষ উঁচু। অতীতের কাহিনি সে বলে বটে।–সমস্ত রকম মিথ্যা রাগ-বিরাগ-কল্পনার খাদমুক্ত অতীতের খাঁটি সত্য। কিন্তু সত্য গল্প বলাই ইতিহাসের কাজ নয়, যদিও গল্প সত্য হলে লোকের তাতে বেশি অনুরাগ। লোকে ভূতের গল্পেও সত্য-ভূতের গল্প শুনতে চায়; কারণ গল্প বলাটা ইতিহাসের উপলক্ষ না হোক, উপায় মাত্র। (ইতিহাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, অতীতের আলোতে বর্তমানের পথ দেখানো, সমাজ ও গোষ্ঠীর চলাচলের পথ ও বিপথ দেখিয়ে মানুষকে সাবধান করা) তত্ত্বদশী জ্ঞানীরা যেসব উপদেশ করেছেন তাদের উপদেশের বাস্তব রূপ দেখা যায় ইতিহাসে। (সমাজ ও সভ্যতার অভু্যদয় ও পতনের বন্ধুর পথে মানুষের যাত্রা ও যাত্রাশেষের দিগদর্শন হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস কাহিনিকার নয়, ইতিহাস উপদেষ্টা। মানুষের চরিত্রের নিগূঢ় তত্ত্বদশীদের নীতিসূত্রের ভাষ্য হচ্ছে ইতিহাস।)
২
ইতিহাসের এই উপদেষ্টার পদগৌরব অনেককাল থেকে স্বীকৃত হয়ে আসছে। দশরূপকের লেখক ধনঞ্জয়, যেসব লোক আনন্দনিস্যন্দী নাট্যের ফলও বলেন ইতিহাসের মতো সাংসারিক জ্ঞানের বুৎপত্তি, সেইসব অল্পবুদ্ধি অরসিক সাধুলোকদের নমস্কার করেছেন।
আনন্দনিস্যন্দিষু রূপকেষু
বুৎপত্তিমাত্রং ফলমল্পবুদ্ধিঃ।
যোহপীতিহাসদিবদাহ সাধুঃ
তস্মৈ নমঃ স্বাদপরাঙামুখায়।।
ধনঞ্জয়ের মতে নাট্যের স্থান ইতিহাসের উপরে কি না সে কথা অবাস্তর। (কিন্তু ইতিহাসের কাজ যে আনন্দ দেওয়া নয়, উপদেশ দেওয়া, তার এ অভিমত সুস্পষ্ট।)
ধনঞ্জয় আধুনিক লেখক। মাত্র হাজার বছর পূর্বেকার লোক। কিন্তু ধনঞ্জয়ের সময়ের অনেক পূর্ব থেকেই আমাদের দেশের নানা পুথিতে ইতিহাস নামে বিদ্যার উল্লেখ আছে।
যজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে দ্বিজাতির পাঠ্যের তালিকায় একটি পাঠ্যবিষয় হচ্ছে ইতিহাস।
বাকোবাক্যং পুরাণং চ নারাশংসীশচ গাথিকাঃ।
ইতিহাসাংস্তথা বিদ্যাঃ শক্ত্যাধীতে হি যোহন্বহম। (আচার, ৪৫)
বেদাথৰ্বপুরাণানি সেতিহাসানি শক্তিতঃ।
জপযজ্ঞার্থসিদ্ধ্যর্থং বিদ্যাং চাহধ্যাত্মিকীং জপেৎ।। (আচার, ১০১)
যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি খুব কম করেও ধনঞ্জয়ের পাঁচশো বছর পূর্বের।
মনুস্মৃতিতে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের সময় যেসব শাস্ত্র পড়ে শোনাবার বিধি আছে তার মধ্যে ইতিহাস একটি।
স্বাধ্যায়ং শ্রাবয়েৎ পিত্র্যে ধর্মশাস্ত্ৰাণি চৈব হি।
আখ্যানোনীতিহাসিাংশ্চ পুরাণানি খিলানি চ।৷ ৩।২৩২
মনুস্মৃতির যে পুথি আমরা পেয়েছি, খ্রিস্টীয় অষ্টম কি নবম শতকে মেধাতিথি যার ভাষ্য লিখেছিলেন, তার রচনা বা গ্রন্থন-কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মতভেদ আছে। কিন্তু কোনওমতেই সে রচনাকাল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরে নয়। তার চেয়ে দু-তিনশো বছর পূর্বে হওয়াই খুব সম্ভব।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্ৰে সামবেদ ঋগবেদ ও যজুৰ্বেদ এই ত্রয়ীর বাইরে ইতিহাসকেও অথর্ববেদের সঙ্গে বেদ বলা হয়েছে।
সামর্গ্যজুৰ্বেদাস্ত্ৰয়ন্ত্রয়ী।
অথর্ববেদেতিহাসবেদেী চ বেদাঃ ॥ (প্রথম প্রকরণ, তৃতীয় অধ্যায়)
ইতিহাসকে বেদ বলতে বোঝা যায় যে, নানা বিদ্যাকে লক্ষ করে ব্যাপক অর্থে শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। ওর অর্থ কী তা রাজার নানাবিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গে কৌটিল্য নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। রাজা দিনের পূর্বভাগে যুদ্ধের নানা অঙ্গের বিদ্যা শিখবেন।
পশ্চিমমিতিহাসশ্রবণে। পুরাণমিতিবৃত্তমাখ্যা-
য়িকেদাহরণং ধর্মশাস্ত্রমর্থশাস্ত্ৰং চেতীতিহাসঃ ॥ (দ্বিতীয় প্রকরণ, পঞ্চম অধ্যায়)
দিনের শেষভাগে ইতিহাস-শ্রবণে শিক্ষালাভ করবেন। পুরাণ, ইতিবৃত্ত, আখ্যায়িকা, উদাহরণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র–এদের বলে ইতিহাস। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল পণ্ডিতদের বিরাট তর্কস্থল। কিন্তু অপণ্ডিত লোকও যদি প্রচলিত মনুস্মৃতির সঙ্গে এ অর্থশাস্ত্র পড়েন তবে প্রতীতি হতে দেরি হয় না যে, কৌটিল্যের বহু অংশ মনুস্মৃতির চেয়ে প্রাচীনতর। সুতরাং যে পণ্ডিতেরা অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল বলেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক তাদের মত অগ্রাহ্য করবার কোনও সংগত কারণ নেই।
গৌতমধর্মসূত্রে, যে-সকল বহুশ্রুত ব্ৰাহ্মণ রাজার সঙ্গে সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থিতি রক্ষা করেন