৫
ইতিহাস কার্যকারণ সম্বন্ধ দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা করে। তার অর্থ এ নয় যে, মানুষ সমাজে ও জীবনে নূতন কিছু ঘটাতে পারে না; তার বর্তমান তার অতীতের কার্য মাত্র, আর তার ভবিষ্যৎ তাব বর্তমানের অবশ্যম্ভাবী ফল। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা যখন ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলে চালাতে চান তখন এমনি একটা ধারণা তাদের ভাবনার মধ্যে গুপ্ত থাকে। সাদা চোখে অবশ্য আমরা সবাই দেখি যে, মানুষ তার জীবনে নিত্য এমনসব ঘটনা ঘটাচ্ছে যা তাব অতীত ও বর্তমান থেকে কেউ কখনও অনুমান করতে পারত না। ঘটনা যখন ঘটে যায়। তখন কার্যকারণ সম্বন্ধ দিয়ে তার ব্যাখ্যাও সম্ভব হয়। কিন্তু তত্ত্বের খাতিরে সত্যকে উপেক্ষা না করলে সহজেই বোঝা যায় যে, কাৰ্যকারণের ব্যাখ্যা পেলেই নূতনের অভিনবত্ব দূর হয় না। মানুষের ইতিহাসে যেগুলি তার গৌরবের অধ্যায়। তার অনেক ঘটনাকে মানুষ ঘটিয়েছে অতীতকে অতিক্রম করে, বর্তমানকে নাকচ করে–ইতিহাসকে ধরে থেকে নয়।
বাঙালি ঐতিহাসিক শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের যে প্ৰবন্ধ থেকে পূর্বে বচন তুলেছি তাতে তিনি কাৰ্যক্ষেত্রে ঐতিহাসিক হিসাব-কিতাবের আবশ্যকতা প্ৰতিপাদনা করিবার জন্য’ যে দুটি উদাহরণ দিয়েছেন তার প্রথম উদাহরণ, ‘অস্পৃশ্যতা বর্জন’, নিয়ে পরীক্ষা করা যাক। চন্দমহাশয় ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ থেকে কয়েকটি ঘটনা তুলে প্রমাণ করেছেন, ‘অস্পৃশ্যকে স্পর্শ করিলে উভয় পক্ষই পাপভোগী হইবে, এইপ্ৰকার বিশ্বাস অস্পৃশ্যতার মূল।’ এবং তিনি বলেন, ‘এইপ্ৰকার বিশ্বাস হিন্দু সাধারণের মধ্যে এখন খুব দুর্বল হইলেও, ইহার বীজ যে এখনও হিন্দুর মনের ভিতর হইতে অন্তহিঁত হইয়াছে এমন কথা বলা যায় না।’ এর শেষ সত্যটি ঐতিহাসিক সত্য নয়, বর্তমান কালের কথা। যার চোখ আছে সে, চৈতন্যচরিতামৃত পড়া না থাকলেও, বর্তমান হিন্দুসমাজ দেখে এ তথ্য জানতে পারবে। যার সে চোখ নেই চৈতন্যচরিতামৃত তার এ কাজে কোনও সাহায্য করবে না। তার পর চন্দমহাশয় বলেছেন, ‘ধর্মবিশ্বাস অপেক্ষাও অস্পৃশ্যতার প্রবলতর সহায় জাত্যভিমান। ইউরোপ এবং আমেরিকা প্রত্যাগত অনেকের হিন্দুজাতিতে উঠিবার আকাঙক্ষণ হইতে বুঝিতে পারা যায় জাত্যভিমান কি প্রবল পদার্থ।’ চন্দমহাশয় প্রশ্ন করেছেন, ‘এই প্রবর্ধমান ব্যাধির আরোগ্যের উপায় কি?’ এবং উত্তর দিয়েছেন, ‘আমার মনে হয়, এই ব্যাধির আরোগ্যের প্রধান উপায়, যথাবিধি সামাজিক রীতিনীতির ইতিহাস অনুশীলন এবং জনসাধারণকে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক হিসাবে এই সকল বিষয়ের বিচার করিতে শিক্ষা দেওয়া।’
ঐতিহাসিক অনুশীলন ও বৈজ্ঞানিক বিচার যে কী উপায়ে অপচীয়মান ধর্মবিশ্বাস ও প্রবর্ধমান জাত্যভিমানের ধ্বংস করবে। চন্দমহাশয় তা কিছু বলেননি। ইতিহাস অনুশীলনে হয়তো পাওয়া যাবে যে, মানুষের সমাজে বড়-ছোটর বোধ সভ্যতার সঙ্গে একবয়সি। আর ওই ভেদকে অবলম্বন করেই সভ্যতার ইমারত গাথা আরম্ভ হয়েছিল। এ বোধ বা জাত্যভিমান যা হোক কিছু-একটাকে অবলম্বন করে চিরদিন মানুষের সমাজে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর যথাবিধি’ ঐতিহাসিক শিক্ষাটি কী? এ ভেদকে দূর করলে সভ্যতার মন্দির ভেঙে পড়বে, না সভ্যতার মন্দির এতটা গড়ে উঠেছে যে ও ‘স্কাফেলিডিং’ এখন সরিয়ে নেওয়া চলে? এর কোনও অনুমানকেই কি অনৈতিহাসিক বলা যায়? আর যদি বলাও যায় তবে ইতিহাসের তর্কে হেরে এক মতের লোক অন্য মতের চালে চলবে এ মনে করা মানব-চরিত্রের সূক্ষ্মদৃষ্টির পরিচয় নয়। লেনিন ও মুসোলিনির দ্বন্দ্ব যে ঐতিহাসিক সম্মিলনীতে মীমাংসা হবে এ স্বপ্ন ঐতিহাসিকেও কখনও দেখে না। আর রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় কি সত্য সত্যই বিশ্বাস করেন যে ‘অ্যানথ্রপলজি’ থেকে মানুষ সমাজ-সংস্কারের প্রেরণা পাবে?
চন্দমহাশয় চৈতন্যচরিতামৃতের যেসব ঘটনা তুলেছেন তার প্রধান কথা, শ্ৰীচৈতন্য স্পশ্যাম্পৃশ্যের ধর্ম-সংস্কারকে নিজে বিন্দুমাত্র মানতেন না।
‘মোরে না ছুঁইহ প্ৰভু পড়োঁ তোমার পায়।
একে নীচ জাতি অধম আর কণ্ডুরস গায়।।
বলাৎকারে প্রভু তারে আলিঙ্গন কৈল।
কণ্ডুক্লেদ মহাপ্রভুর শ্ৰীঅঙ্গে লাগিল।।’
এ যে ‘ঐতিহাসিক অনুশীলন’ বা ‘বৈজ্ঞানিক বিচার’-এর ফল নয় তা চন্দমহাশয়কেও স্বীকার করতে হবে। চৈতন্যের যেসব ভক্তেরা তাঁর পণ্ডিত্যের দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন তাঁরাও তাদের তালিকায় ইতিহাস ও বিজ্ঞানের নাম উল্লেখ করেননি। মহাপ্ৰভু ‘কগুক্লেদ গায়’ অস্পৃশ্যকে আলিঙ্গন দিয়েছিলেন ইতিহাস অনুশীলন করে নয়, সমস্ত ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে।
সমাজে নূতন কিছু আনতে হলে শ্ৰীচৈতন্যের প্রয়োজন হয়। ইতিহাস-অনুসন্ধান-সমিতি দিয়ে সে কাজ চলে না। মানুষ জীবনের টানে এগিয়ে চলে, সৃষ্টির প্রেরণায় নুতন সৃষ্টি করে। ইতিহাস জীবনের এই সৃষ্টিলীলার দর্শক। এ লীলার কলাকৌশল বুঝলেই সৃষ্টির ক্ষমতা আসে না, যেমন কাব্য বুঝলেই কবি হওয়া যায় না। তা যদি হত। তবে মমসেন ইতিহাসের পুথি না লিখে একটা রাজ্যস্থাপন করতেন, আর ব্র্যান্ডুলির হাতে আর-একখানা হ্যামলেট লেখা হত।
ইতিহাসের মুক্তি
মানুষ মানুষের কথা শুনতে ভালবাসে— প্রাচীন মানুষের কাহিনি, সমকালীন মানুষের সংবাদ। আধুনিক সভ্য জগতে এই দ্বিতীয় চাহিদার জোগান দেয় খবরের কাগজ। প্রথম আকাঙ্ক্ষাটি পূরণের জন্য অনেক পূর্ব থেকেই মানুষ রচনা করছে। ইতিহাস। কোনও ঐতিহাসিক নিশ্চয়ই স্বীকার করতে রাজি হবেন না যে তাদের ইতিহাস-রচনা খবরের কাগজ প্রকাশের সমধর্মী। ইতিহাস গড়ার মালমশলা, প্রত্নতাত্ত্বিক ও সম্ভব অসম্ভব নানা মূল থেকে বহু বিচিত্র উপাদান সংগ্ৰহ কি খবরের কাগজের জন্য ঋজু পথে ও কুটিল কৌশলে সাংবাদিকের সংবাদ-সংগ্রহের সমতুল্য? সংগৃহীত সংবাদের সত্যাসত্য ও লঘুগুরু যাচাই করে সম্পাদকীয় সন্দর্ভ যে তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশ করে, সংগৃহীত উপকরণের তীক্ষ বিশ্লেষণে ও নির্মম বিচারে খাঁটি সত্য নির্ণয় করে ঐতিহাসিক সে ব্যাপারের যে বিবরণ দেন ও তার মৰ্মগত ঐতিহাসিক তত্ত্বের বিচার করেন, সে কি ওই খবরের কাগজের সম্পাদকীয় সন্দর্ভের সমগোত্রীয়? নিজ কর্মের গুরুত্বে অবহিত কোনও আত্মসম্মানী ঐতিহাসিক এমন কথা ভাবতে পারেন যে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাছে তিনি অতীত ঘটনার সাংবাদিক! যদিচ মনে পড়ছে, ইংরেজ লেখক ওয়ার্ড ফাউলার তার রোমের চটি ইতিহাসে, প্রাচীন রোমান সেনেটের যে বিবরণ পণ্ডিতেরা অনেক নিরীক্ষা-পরীক্ষায় সংগ্রহ করেছেন, তার কিছু পরিচয় দিয়ে বলেছেন যে, এসব পাণ্ডিত্য বিস্মৃতির অতলে ডোবাতে তিনি রাজি আছেন যদি ওই রোমান সেনেটের একদিনকার অধিবেশনে তিনি উপস্থিত থাকতে পারতেন, অর্থাৎ যদি একদিনের অধিবেশনের রিপোর্টার হতে পারতেন।