২
বর্তমান যে অতীতের ইতিহাসকে কাজে লাগায় না তা নয়। বর্তমানের কাজে মানুষ প্রাচীন ইতিহাস অনেক সময়েই ডেকে আনে; কিন্তু সে উপদেশ লাভের জন্য নয়, অতীতকে উদ্দেশ্যসিদ্ধির উপায়স্বরূপ অস্ত্রের মতো ব্যবহারের জন্য। ইতিহাসে যা এর অনুকুল লোকে তাকে প্রচার করে; যা প্রতিকূল তার দিকে চোখ বুজে থাকে। ইংল্যান্ডের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর পলিটিশ্যনেরা দেশের প্রাচীন ইতিহাস থেকে নজির তুলে রাজশক্তির বিরুদ্ধে জনসাধারণের স্বত্ব ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে ইতিহাস যে সব সময়েই সত্য ইতিহাস, তার ব্যাখ্যা যে সকল সময়েই নির্ভুল ব্যাখ্যা হত–এ কথা এখন কোনও ঐতিহাসিক স্বীকার করবে না। কিন্তু ওই ইতিহাসই ছিল সেদিনের কাজের ইতিহাস। বিশুদ্ধ ও নির্ভুল ইতিহাসে সেদিনকার কাজ চলত না, কাজ অচল হত; এর উদাহরণের জন্য সাগর-পারে যাবার প্রয়োজনও নেই। বর্তমান হিন্দুসমাজের যাঁরা সংস্কার চান আজ তাঁরা হিন্দুর প্রাচীন ইতিহাস থেকে নজির আনছেন, আর যাঁরা সে সংস্কারকে বন্ধ রাখতে চান তাঁরাও ওই ইতিহাস থেকেই নজির তুলছেন। এর কোনও ইতিহাসই সম্পূর্ণ সত্য নয় বা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। গোটা প্রাচীন ইতিহাসকে কোনও কাজে লাগানো যায় না, তা থেকে অংশবিশেষ বেছে নিতে হয়। কে কোন অংশ বেছে নেবে তা ঐতিহাসিক সত্যের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে তার গরজের উপর।
৩
যাকে ‘ঐতিহাসিক সত্য’ বলা হয়—যা থেকে মানুষ তার বর্তমান গতিবিধি সম্বন্ধে মূল্যবান উপদেশ পায় বলে অনেকের বিশ্বাস–তার স্বরূপটি কী? যা ঘটে গেছে সেই ঘটনার তথ্য নির্ণয় ‘ঐতিহাসিক সত্য’ নয়, প্রত্নতত্ত্ব মাত্র। ইতিহাস থেকে যাঁরা উপদেশ চায়। তাঁরা ধরে নেয়, সে ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্যের মধ্যে তত্ত্ব লুকিয়ে রয়েছে, যাকে ঘটনার বিশেষত্ব থেকে মুক্ত করে আবিশেষ সাধারণ সত্য বলে ব্যবহার করা চলে। ঐতিহাসিকের সবচেয়ে বড় কাজ, প্রত্নতত্ত্বের তথ্য থেকে এই ঐতিহাসিক সত্য বা তত্ত্বের আবিষ্কার করা। প্রতি ইতিহাসের মধ্যেই কোনও-না-কোনও তত্ত্ব আছে। যথার্থ ঐতিহাসিকের চোখে সে তত্ত্ব ধরা পড়ে।
সমসাময়িক ঘটনা, অনুষ্ঠান ও অনুষ্ঠাতৃদের সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ও মত এক নয়। এদের মূল্য ও ভালমন্দ-বিচারে মতভেদের অন্ত নেই। বর্তমান থেকে অতীতের কোঠায় গেলেই যে এদের মূল্য সবার চোখে এক দেখাবে, এদের বিচারে মতভেদের অবসর থাকবে না, এমন বিশ্বাসের কারণ কী? বর্তমানের ঘটনা নিয়ে অনেক তর্ক যে ভবিষ্যতের ঘটনা দিয়ে মীমাংসা হয় সে কথা সত্য, কিন্তু ঘটনা থেকে যে তত্ত্বোপদেশের আশা করা হয় তার তর্কের অবসান নেই। কারণ একই ইতিহাস সকলের চোখে ও সকল সময়ের চোখে একরূপ নয়। মানুষের মনের আশা ও আকাঙ্ক্ষা, ভাব ও চিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে ইতিহাসেরও মূর্তি পরিবর্তন হয়। মানুষের যাত্রাপথের প্রতি বঁকি থেকে পিছনের ইতিহাসের চেহারা বিভিন্ন দেখায়–যেমন পাহাড়-পথের যাত্রী পথের নানা স্থান থেকে সমতলভূমির নানা চেহারা দেখে। এর কোন চেহারা সত্য, কোন চেহারা মিথ্যা? প্রতি যুগের মানুষ ইতিহাসকে নূতন করে লিখছে ও নূতন করে লিখবে। ইতিহাসের এই নূতন নূতন রূপের কোনও রূপই মিথ্যা নয়, কারণ ও সব রূপই ব্যাবহারিক অর্থাৎ আপেক্ষিক। ইতিহাসের কোনও পারমার্থিক কাপ নেই। ইতিহাসের ঘটনানির্ণয়ের শেষ থাকতে পারে, কিন্তু তার ব্যাখ্যার কখনও শেষ হবে না।
ইতিহাসকে যাঁরা উপদেশের খনি মনে করে তাঁরা তার এই রূপ-পরিবর্তনের কথাটা ভুলে থাকে। অথচ ইতিহাস সম্বন্ধে এর চেয়ে সহজ সত্য আর কী আছে। কোন বড় ঐতিহাসিক ঘটনা অথবা ব্যক্তির বিচারে ঐতিহাসিকেরা একমত? বেশি উদাহরণের প্রয়োজন নেই, এক ফরাসি বিপ্লব ও তার কমীদের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে ও হচ্ছে, তার কথা মনে করলেই যথেষ্ট হবে। ইতিহাসের ঘটনা ঐতিহাসিক তত্ত্বের উদাহরণ নয়। ও তত্ত্ব মানুষ নিজের মনে মনে গড়ে নেয়, অর্থাৎ যার যেমন মন সে তেমনি তত্ত্ব ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পায়। ইতিহাসের যে উপদেশ তা ইতিহাস থেকে মানুষের মনে আসে না, মানুষ নিজের মন থেকে ইতিহাসে তা আরোপ করে।
৪
মানব-সমাজের গতি নিয়ন্ত্রিত হয় তার জীবনের প্রয়োজনে। মানুষের আশা ও ভয়, বর্তমানের চাপ ও ভবিষ্যতের কল্পনা, তার জীবনের পথ কেটে চলেছে। ইতিহাসের কাজ জীবনের এই বিচিত্ৰ লীলাকে দর্শন করা, মনন করা, নিদিধ্যাসন করা। যেসব তত্ত্ব দিয়ে মানুষ জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চায়, জীবন তাদের চেয়ে অনেক জটিল। তাই কোনও ঐতিহাসিক তত্ত্বই ইতিহাসের চরম ব্যাখ্যা দিতে পারে না, এবং এক আংশিক ব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট হয়ে ঐতিহাসিকেরা অন্য এক আংশিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। ইতিহাস-জ্ঞানের চরম লাভ, মানবসমাজের গতি ও পরিণতির এই রহস্যলীলার সঙ্গে পরিচয়। যে ইতিহাস পাঠকের মনে এই রহস্যের বোধকে জাগিয়ে তোলে সেই ইতিহাসই যথার্থ ইতিহাস। বাকি সব হয় গল্প নয় প্রপাগান্ডা। ইতিহাস জীবনলীলার কাব্য। যার চোখে আটিস্টের উদার দৃষ্টি নেই, আজকের দিনের ভালমন্দারাগবিরাগের উপরে উঠে মানুষের জীবনধারাকে যে দেখতে জানে না, তার ঐতিহাসিক হবার চেষ্টা বিড়ম্বনা। আর ইতিহাসের প্রতি পাতায় যাঁরা উপদেশ খোঁজে তাদের বিশ্বাস, ইতিহাস হচ্ছে কথামালারই জ্ঞাতি-ভাই।