করিতে হয়। ‘বিজ্ঞানসম্মত’ হইলেও প্রকৃতপক্ষে ও সূত্রটা কেহ মানিয়া চলে না, এবং প্রয়োজন হইলে রাখালবাবুও মানেন না। তিব্বতের তারানাথ গোপালদেব গৌড়বাসীর রাজা হইবার অব্যবহিত পূর্বের অবস্থা সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, ‘প্রতিদিন এক-একজন রাজা নির্বাচিত হইতেন, কিন্তু ভূতপূর্ব রাজার পত্নী রাত্ৰিতে তাহাদিগকে সংহার করিতেন। কিছুদিন পরে গােপালদেব রাজপদ লাভ করিয়া, রাস্ত্রীর হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিয়া, আমরণ সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন।’ এই রাজপত্নীর গল্প সম্বন্ধে রাখালবাবু লিখিয়াছেন, ‘তারানাথের ইতিহাস বিশ্বাসযোগ্য নহে, কিন্তু ধর্মপালদেবের তাম্রশাসনে যখন গোপালদেবের নির্বাচনের কথা আছে তখন তাহার উক্তির এই অংশমাত্র গ্রহণ করা যাইতে পারে যে, গোপালদেবের পূর্বে ভূতপূর্ব রাজপত্নীর অত্যাচারে দেশে অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল।’ সুতরাং ‘বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালীতে রচিত ইতিহাস’ যে একই গ্রন্থের একই বিষয়ে এক অংশ পরিত্যাগ করিয়া অপর অংশ গ্ৰহণ করিয়া থাকে কেবল তাই নয়, একই ছত্রের এক অংশকে উপকথা এবং অন্য অংশকে সত্য বলিয়াও সাব্যস্ত করে। এইরূপে রাখালবাবু তাহার. গ্রন্থে বহুবার বহু স্থলে বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালীর কথা তুলিয়াছেন। কিন্তু তাহার কথার অর্থ, সাধারণ সুযুক্তি-সংগত প্ৰণালী ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত কথা এই যে, যে জাতীয় সত্য ইতিহাসের লক্ষ্য, তাহা দৈনন্দিন জীবনে সর্বসাধারণ যাহা লইয়া কারবার করে সেই রকম সত্য। সুতরাং সে সত্য আবিষ্কারের প্রণালীও সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষের প্রতিদিনকার কাজের যুক্তির প্রণালী। সে প্রণালীতে কোনও বৈজ্ঞানিক বিশেষত্বের আশা করা দুরাশা।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালীর কথা পুনঃ পুনঃ শুনিয়া মনে হয়, বুঝি পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধানের কতকগুলি বাধা নিয়ম আছে যাহা মানিয়া চলিলেই ঐতিহাসিক সত্যে পৌঁছনো যায়। এর চেয়ে ভুল ধারণা আর নাই। ইতিহাসে বিজ্ঞান নয়, কিন্তু সত্যে পৌঁছিবার বাঁধা রাস্তা যেমন বিজ্ঞানেরও নাই, তেমনি ইতিহাসেরও নাই। এইরূপ পাকা রাস্তা থাকিলে কি বিজ্ঞানে কি ইতিহাসে প্রতিভাবান ও প্রতিভাহীনের একদর হইত। কিন্তু প্ৰতিভাবান ছাড়া তো কেহ ইতিহাস গড়িয়া তুলিতে পারে না। এ মজুরের দালান-গাঁথা নয় যে ইটের উপর ইট বসাইয়া গেলেই হইল। যে উপাদান লইয়া সাধারণ লোকে কিছুই করিতে পারে না, ঐতিহাসিক প্রতিভা যার আছে। তিনি তাহা হইতেও সত্যের কল্পনা করিতে পারেন এবং অনুসন্ধানে সেই কল্পনা সত্য বলিয়া প্রমাণ হয়। সবরকম বড় সত্যে পৌঁছিবারই এই পথ। তার পর এও ভুলিলে চলিবে না যে, ঐতিহাসিকের আসল কাজ ধ্বংস করা নয়, গড়া। সত্য অনুসন্ধানের একটা অসম্ভব আদর্শ খাড়া করিয়া কিছুই বিশ্বাস করি না বলিয়া মুখ ফিরাইয়া বসিয়া থাকিলেই যে ঐতিহাসিক সত্য আসিয়া হাতে ধরা দিবে, এমনও বোধ হয় না।
হয়তো উত্তরে শুনিব যে, বিজ্ঞানের যেটা লীলাভূমি সেই সাগরপারে বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের নিয়মকানুন কাটাছোটা হইয়া ঠিক হইয়া গিয়াছে, সুতরাং ইতিহাসের যে একটা বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালী আছে তাহাতে আর সন্দেহ করা চলে না। এই আইনকানুন যে ঠিক হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ করি না। কিন্তু তাহা হইলে সমুদ্রপারের ঐতিহাসিক পণ্ডিতদের ‘বিজ্ঞান বিজ্ঞান’ খেলা। এ খেলার প্রবৃত্তি কেন হয় এ প্রবন্ধে তাঁহাই দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি। সুতরাং লর্ড অ্যাকটন বা সীলীর বচন তুলিয়া কোনও লাভ নাই।
মানবজাতির মুক্তির জন্য ভগবান তথাগত যে চারটি মহাসত্যের প্রচার করিয়াছিলেন তাহার একটি এই যে, সকল জিনিসই নিজের লক্ষণে বিশিষ্ট–’সৰ্বং সলক্ষণাং স্বলক্ষণং’। এক নাম দিয়া ভিন্ন বস্তুকে এক কোটায় ফেলা যায়, কিন্তু তাহাতে বিভিন্ন জিনিস এক হয় না। বর্তমান যুগে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গণ্ডির বাহিরে যে-সকল বিদ্যা আছে তাহাদের মুক্তির জন্য ভগবান বুদ্ধের বাণীর নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছে।