সাধারণ জ্ঞানের প্রণালী ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রণালী মূলে এক হইলেও, বিজ্ঞান যে ব্যাপক গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞান চায় তাহার জন্য তাকে নানারকম কৌশল আবিষ্কার করিতে হয়। বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি, গণিত, পরীক্ষা এইগুলিই সেই কৌশল। ইহার কোনওটির লক্ষ্য অতিদূর বা অতিসূক্ষ্মকে ইন্দ্ৰিয়ের গোচরে আনা, কোনওটির উদ্দেশ্য এক বস্তুকে অপর বস্তু হইতে তফাত করিয়া অন্য অবস্থায় তার গুণাগুণ পরীক্ষা করা, কোনওটির চেষ্টা যে কাজের নিয়মটা এমনি ভাল বোঝা যায় না। তাকে গণিতের কলে ফেলিয়া আয়ত্ত করা–এই কৌশলগুলিতেই বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীর বিশেষত্ব এবং ইহারাই বিজ্ঞানের উন্নতির প্রধান সহায়। কিন্তু এই বিশেষত্ব অতি বিশিষ্ট রকমের বিশেষত্ব। অর্থাৎ যে কাজের জন্য যে কৌশলটির দরকার সেই কাজ ছাড়া আর অন্য কাজে তাহাকে প্রয়োগ করা বড় চলে না। কারণ এই কৌশলের আকার ও ভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত হয় জ্ঞানের বিষয়লক্ষ্যের দ্বারা। কাজেই এক বিজ্ঞানের কৌশলকে অন্য বিজ্ঞানে বড় কাজে লাগান চলে না এবং একই বিজ্ঞানের এক বিভাগে যে কৌশল চলে অন্য বিভাগে তাহা অনেক সময় অচল। গতি-বিজ্ঞানে যে গণিত দিগ্বিজয়ী, রসায়ন-বিজ্ঞান তাকে কাজে লাগাইতে পারে না। রসায়নের যে বিশ্লেষণ-প্ৰণালী, তাড়িত-বিজ্ঞানে তাহার প্রভাব নাই।
কাজেই ব্যাপার দাঁড়াইতেছে এই যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রণালীর যাহা বিশেষত্ব তাহাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বাহিরে নেওয়া চলে না। এই বিশেষত্বের বেশির ভাগই প্ৰত্যেক বিজ্ঞানের জন্য স্বতন্ত্র, বিজ্ঞান-বিশেষেই বিশেষভাবে আবদ্ধ। আর যাহা সমস্ত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেই সাধারণ তাহা মোটেই বিজ্ঞানে অনন্যসাধারণ নয়। তাহা হইতেছে সাধারণ যুক্তি ও জ্ঞানের প্রণালী, এ বিষয়ে বিজ্ঞানে ও সাধারণ-জ্ঞানে কোনও ভেদ নাই। এই প্ৰণালীকে বৈজ্ঞানিক প্ৰণালী বলিয়া কোনও লাভ নাই। কেননা এখানে বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক উভয়েরই আসন এক জায়গায়।
সুতরাং ঐতিহাসিক যখন বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালীর কথা বলেন তখন প্রথমেই সন্দেহ হয় যে, তাহার কথাটার অর্থ, যুক্তিসংগত প্ৰণালী ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কেবল এইটুকু বলিলে লোকের মনোযোগও যথেষ্ট আকৃষ্ট হয় না এবং বিষয়টাকেও সেরকম মর্যাদা দেওয়া হয় না। বিজ্ঞানের নামের মন্ত্র উচ্চারণ করিলে এই দুই কাজই অনেক সময় কী যেন একটা শক্তির বলে অচিন্তিত উপায়ে সিদ্ধ হইয়া যায়।
দুই-একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। শ্ৰীযুক্ত রাখালদাসবাবুর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ আমাদের দেশের নবীন ইতিহাস-চৰ্চার একটি প্রথম ও প্রধান ফল। সেই পুথি হইতে দৃষ্টান্ত তুলিব।
দিনাজপুর জেলায় বাণগড়ে মহীপালদেবের যে তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাতে লেখা আছে যে, মহীপালদেব বাহুবলে সকল বিপক্ষ দল সংগ্রামে নিহত করিয়া অনধিকৃত বিলুপ্ত’ পিতৃরাজ্য গ্রহণ করিয়া অবনীপাল হইয়াছিলেন। ওই তাম্রশাসনেই তাঁহার পিতা বিগ্রহপালদেবের বিষয় উল্লিখিত আছে যে তিনি সূৰ্য হইতে বিমল কলাময় চন্দ্রের মতো উদিত হইয়া ভুবনের তাপ বিদূরিত করিয়াছিলেন। এবং তাঁহার রাণহস্তীগণ প্রচুরপয়ঃ পূৰ্বদেশ হইতে মলয়োপত্যকার চন্দন-বনে যথেচ্ছ বিচরণ করিয়া হিমালয়ের অধিত্যকায় উপস্থিত হইয়াছিল। শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয় মহাশয় এই তাম্রশাসনের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন, ‘মহীপালদেবের পিতার কোনোরূপ বীরকীর্তির উল্লেখ নাই। তাঁহাকে সূৰ্য হইতে চন্দ্ররূপে উদ্ভূত বলিয়া এবং তজ্জন্য ‘কলাময়’ত্বের আরোপ করিবার সুযোগ পাইয়া কবি ইঙ্গিতে তাহার ভাগ্যবিপর্যয়ের আভাস প্ৰদান করিয়া থাকিবেন। তাহার সেনা ও গজেন্দ্ৰগণ (আশ্রয়স্থানাভাবে) নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া, শিশির-সংযুক্ত হিমাচলের অধিত্যকায় আশ্রয়লাভের কথায় এবং মহীপালদেবের ‘অনধিকৃত বিলুপ্ত’ পিতৃরাজ্য পুনঃপ্রাপ্তির কথায়, দ্বিতীয় বিগ্রহপালদেবের শাসন-সময়েই পাল-সাম্রাজ্যের প্রথম ভাগ্যবিপর্যয়ের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে।’ এই ব্যাখ্যা সম্বন্ধে রাখালবাবু টীকা করিয়াছেন, ‘মৈত্ৰেয়মহাশয়ের উক্তি সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানসম্মত।’ এ কোন বিজ্ঞান? মৈত্ৰেয়মহাশয়ের ব্যাখ্যা সুযুক্তিসংগত এবং রসজ্ঞতারও পরিচায়ক বটে এবং তিনিও সেইভাবেই কথাটা লিখিয়াছেন। ইহার মধ্যে বিজ্ঞান বেচারাকে টানিয়া আনা কেন?
কলহণ রাজতরঙ্গিণীতে কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের গৌড়ের রাজাকে হত্যার এবং রাজ-হত্যার প্রতিশোধের জন্য গৌড়পতির ভৃত্যগণের পরিহাস কেশব’-নামক দেবতার মন্দির অবরোধ ও তাহদের বীরত্বের এক কাহিনি বর্ণনা করিয়াছেন। ‘গৌড় রাজমালায় শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করিয়াছেন যে এই কাহিনি সম্ভবত অমূলক নয়, কেননা কলহণ প্রচলিত জনশ্রুতি অবলম্বনেই এই বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এবং মূলে সত্য না। থাকিলে কাশ্মীরে গৌড়ীয়গণের বীরত্বকাহিনির কোনও জনশ্রুতি থাকিবার কথা নয়। এ সম্বন্ধে শ্ৰীযুক্ত রাখালবাবু লিখিয়াছেন, ‘শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ, কলহণ মিশ্র কর্তৃক লিপিবদ্ধ গৌড়ীয়গণের বীরত্বকাহিনী অমূলক মনে করেন না, এবং বলেন যে, প্রচলিত জনশ্রুতি অবলম্বনেই কলহণ এই বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া থাকিবেন। কিন্তু কলহণ কর্তৃক লিপিবদ্ধ ললিতাদিত্যের দক্ষিণাপথ-বিজয়-কাহিনী কিঞ্চিৎ পরিমাণে কল্পনাপ্রসূত বলিয়া মনে করিতে তিনি কোনো দ্বিধা বোধ করেন নাই। একই গ্রন্থকার কর্তৃক লিখিত একই গ্রন্থে একই বিষয়ে এক অংশ অমূলক এবং দ্বিতীয় অংশ সত্যরূপে গ্ৰহণ করা ইতিহাস-রচনাব বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালী নহে।’ তার পর রাখালবাবু আমাদিগকে জানাইয়াছেন যে, রাজতরঙ্গিণীর ইংরাজি-অনুবাদ-কর্তা স্টাইন-সাহেব এ ঘটনাটা সত্য বলিয়া গ্ৰহণ করিতে প্রস্তুত নহেন।’ স্টাইন-সাহেবের মত সত্য হইতে পারে এবং রমাপ্রসাদবাবুর ভুল হইতে পারে, কিন্তু কোনও জনশ্রুতির মুলে সত্য আছে কি না তাহা স্থির করিবার কোনও বাঁধা ‘বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালী’ নাই। চারি দিক দেখিয়া এ কথাটা বিচার করিতে হয়, শেষ পর্যন্ত হয়তো ইহা অল্পবিস্তর মতামতের বিষয়ই থাকিয়া যায়। কিন্তু এই বিষয়ের প্রণালীর মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিশেষত্ব কিছু নাই। সচরাচর দশজনে একটা কথার সত্যমিথ্যা নির্ণয় করিতে হইলে যে-রকমভাবে বিচার করে এও ঠিক সেই রকমের বিচার। তারপর সম্ভবত একটু অবাস্তর হইলেও না বলিয়া থাকা যায় না যে রাখালবাবু তীহার ‘বিজ্ঞানসম্মত প্ৰণালী’র যে একটি সূত্রের কথা এখানে বলিয়াছেন তাহা নিতান্তই অচল। সে সূত্র আর কোনও বিচার না