সুতরাং আজ যে সকল শাস্ত্রের আচার্যেরাই বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক প্রণালীর দিকে ঝুকিয়া পড়িয়াছেন ইহাতে নূতনত্ব কিছু নাই, এমন ঘটনা পূর্বেও অনেকবার ঘটিয়া গিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও অনেকবার ঘটিবে। বর্তমান যুগের শরীর ও মন বিজ্ঞানের বলেই গড়িয়া উঠিয়াছে। আমরা এক দিকে দেখিতেছি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলির জ্ঞানের পথে অপূর্ব সফলতা, অন্য দিকে দেখিতেছি। কর্মের জগতে তাদের বিস্ময়কর পরিণতি। সুতরাং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গণ্ডির বাহিরের বিষয় লইয়া যাদের কারবার তাঁরা যে একবার ওই বিজ্ঞানের পথটা ধরিয়া চলিবার চেষ্টা করিবেন তাহা নিতান্তই স্বাভাবিক। যখন দেখা যাইবে যে ও পথটা যতই প্রশস্ত হোক। ওটা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেরই গন্তব্য পথ, অন্য বিদ্যাগুলির নয়, তখন মোড় ফিরিবার কথা মনে আসিবে। যাহাকে ঘাটে যাইতে হইবে সে যদি হাটের পথের শোরগোল দেখিয়া সেই পথেই চলিতে শুরু করে তবে ঘাটে পৌঁছিতে বিলম্ব ছাড়া আব কোনও ফল হয় না।
আমাদের নব্য-ইতিহাসের আচার্যেরা যে এইসব ভাবিয়া চিন্তিয়া, এইসব গভীর অগভীর কারণে চালিত হইয়া বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীর কথা তুলিয়াছেন, এমন কথা আমি বলিতেছি না। কেননা আমাদের দেশে এ কথাটা ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড়ের মতো একেবারে বিলাত হইতে তৈরি মালই আসিয়াছে; এবং ইংরেজি পুথির মাড়োয়ারি মহাজন ইহাকে ঘরে ঘরে ছড়াইযা দিয়াছে। সুতরাং ইতিহাস অনুসন্ধানের সম্পর্কে এই বৈজ্ঞানিক প্রণালী কথাটার মূলে কোনও বস্তু আছে কি না সে আলোচনা আমাদের দেশে নিষ্প্রয়োজন বা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
২
অবাস্তর কথা বাদ দিয়া মূল কথা বলিতে গেলে কেবল এইমাত্রই বলিতে হয় যে, বিজ্ঞানবিদ্যার কাজ, প্রকৃতির বিভিন্ন বিজ্ঞানের কাজের প্রণালী ও প্রকৃতির বিবিধ শক্তি ও ধর্মের আবিষ্কার করা। কিন্তু এই কাজ কিছু বিজ্ঞানবিদ্যারই একচেট নয়। পৃথিবীতে যেদিন হইতে মানুষের জন্ম হইয়াছে, মানুষ যখন বনে জঙ্গলে গিরিগুহায় বাস করিত, সেদিন হইতে কেবলমাত্ৰ দেহরক্ষার জন্যই মানুষকে অল্পবিস্তর এই কাজে হাত দিতে হইয়াছে। মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাইতে পারিয়াছে সেদিন সে প্রকৃতির এক মহাশক্তি আবিষ্কার ও আয়ত্ত করিয়াছে। যেদিন কৃষিকাৰ্য আরম্ভ করিয়াছে সেদিন তো প্রকৃতির বহু বিভাগের কাজের প্ৰণালী বাহির করিয়া ফেলিয়াছে। কথা এই যে, জীবনযাত্ৰাটা চালাইবার জন্য মানুষকে তাহার চারিপার্শ্বের প্রকৃতির যে সাধারণ-জ্ঞান অর্জন করিতে হয়, বিজ্ঞানবিদ্যালব্ধ জ্ঞানের সহিত তাহার কোনও জাতিগত প্ৰভেদ নাই। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিশেষত্ব তাহার ব্যাপকতা, গভীরতা ও সূক্ষ্মতায়। সাধারণভাবে ঘরকন্নার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন হয় প্রকৃতির সমস্ত অংশের পরিচয় করা। সুদূর নক্ষত্রের গঠন-উপাদান হইতে আরম্ভ করিয়া অণুবীক্ষণদৃশ্য কীটাণুর জীবন-ইতিহাস পর্যন্ত সমস্তই ইহার জ্ঞাতব্য। জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যে সাধারণ-জ্ঞানের প্রয়োজন তাহা মূলস্পশী না হইলেও চলে; বিজ্ঞানবিদ্যার লক্ষ্য একবারে প্রাকৃতিক ব্যাপারের মূলের দিকে। এক ঋতুর পর অন্য ঋতু আসে ভুয়োদর্শনের ফলে, এই যে জ্ঞান ইহা সাধারণ-জ্ঞান। নির্দিষ্ট পথে নিরূপিত সময়ে সূৰ্য্যমণ্ডলকে প্রদক্ষিণ করিবার জন্য পৃথিবীতে কেমন করিয়া ঋতু-পরিবর্তন হয় সে জ্ঞান বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। উপযুক্ত আহার পাইল শরীর পুষ্ট ও বলশালী হয়, আর আহার-অভাবে শরীর শীর্ণ ও দুর্বল হয়, এ জ্ঞান সাধারণ-জ্ঞান। জীবদেহ কেমন করিয়া ভুক্তদ্রব্য পরিপাক করে এবং পরিপক অন্নরস কেমন করিয়া জীবশরীরের ক্ষয় পূরণ ও উপাদান গঠন করে সে জ্ঞান বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। সাংসারিক কাজের জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহা স্কুল হইলেও চলে, তাহাতে চুলচেরা হিসাবের প্রয়োজন নাই, বরং সে হিসাব করিতে গেলে সুবিধা না হইয়া অনেক সময় কাজ অচল হইয়া উঠিবারই কথা; কিন্তু বিজ্ঞান চায় সকল জিনিসেরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব। একটা চারাগাছ যখন বাড়িতে থাকে তখন প্রতিদিনই কিছু কিছু বাড়ে ইহা সকলেই জানি, ইহা সাধারণ-জ্ঞান। গাছটা প্ৰতি সেকেন্ডে কতটুকু বাড়িতেছে তাহা জানা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। প্রচলিত ঘড়ির সময়ের বিভাগ সাংসারিক কাজের জন্য যথেষ্ট, আচাৰ্য জগদীশচন্দ্ৰকে কতকগুলি পরীক্ষার জন্য এক সেকেন্ড সময়কে হাজার ভাগে ভাগ করা যায় এমন যন্ত্রের উদ্ভাবন করিতে হইয়াছে। সাংসারিক প্রয়োজনের পরিমাপ-যন্ত্র মুন্দির দাড়িপাল্লা, বিজ্ঞানবিদ্যার চাই ‘কেমিক্যাল ব্যালান্স’।
যেমন জ্ঞানে তেমনি জ্ঞানের প্রণালীতে বৈজ্ঞানিকে ও সাধারণে কোনও ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল ভেদ নাই। যে জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের পথে ও কর্মেন্দ্ৰিয়ের চেষ্টায় আমরা বহির্জগতের জ্ঞান লাভ করি সেই ইন্দ্ৰিয়গুলিই বিজ্ঞানেরও ভরসা। যে ন্যায় ও যুক্তি আমরা প্রতিদিনকার সাংসারিক কাজে ব্যবহার করি সেই ন্যায় ও যুক্তির প্রণালীই বিজ্ঞানেরও একমাত্র সম্বল। এমনকী আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য আমরা জগৎ-সংসারটার যে রূপ কল্পনা করি এবং যেরকম ভাগে তাকে ভাগ করি মোটামুটি তাহার উপরেই ভিত্তি করিয়া বিজ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক জগৎ নির্মাণের চেষ্টা করে। এ বিষয়টি ফরাসি দার্শনিক বার্গসো এমন চমৎকারভাবে বুঝাইয়াছেন যে তাহার পর আর কাহারও বাগাড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন।