কুড়ি বছর পূর্বের লেখা; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখনও আরম্ভ হয়নি।
সভ্যতার ভবিষ্যৎ বলা যায়, এ বিশ্বাসের অন্তরে এই স্বীকৃতি লুকিয়ে আছে যে, মানুষের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়েই আছে। মানুষের কর্ম অকর্ম নিমিত্ত মাত্র। এ বিশ্বাস কারও মনে হতাশা আনে, কারও মনে উৎসাহ আনে। সমাজের ক্রমপরিণতিতে যে প্রোলিটারিয়েটের ডিক্টেটরশিপ অলঙঘ্য ও অবশ্যম্ভাবী, এ বিশ্বাস কার্ল মার্কসের মনে উৎসাহ এনেছিল, এবং তিনি অনুচরদের মনে উৎসাহ এনেছিলেন এ বিশ্বাস যে বৈজ্ঞানিক সত্য তার প্রমাণ প্রচার করে। এ বিশ্বাসের মূল কোনও পরীক্ষিত সত্য নয়, মনের আকাঙ্ক্ষা। মানুষের ও তার সভ্যতার ভবিষ্যৎ যদি প্রথম থেকেই নির্ণীত হয়ে থাকে, এবং তা যদি পূর্বেই জানা যায়, জানা যাবে ভবিষ্যদ্ৰষ্টার অপরোক্ষ দৃষ্টিতে, ইতিহাস-জ্ঞানের সরু পথে নয়। সুতরাং ইতিহাসে ভবিষ্যদবাণীর দায়িত্ব অপরোক্ষদৃষ্টি দ্রষ্টাদের ছেড়ে দিয়ে, ঐতিহাসিকদের নিশ্চিন্ত হওয়াই ভাল। মানুষের ইতিহাসের ঋজু কুটিল পথে বিচিত্র গতির যে বিস্ময়, মানুষের মনে সে বিস্ময় জাগাতে পারলেই ঐতিহাসিক ধন্য হবেন।
বৈজ্ঞানিক ইতিহাস
বাঙালি যে নিজের দেশের ইতিহাস অনুসন্ধানে উৎসাহহীন, স্বদেশের প্রাচীন কাহিনির জন্য বিদেশির দ্বারস্থ, কিছুদিন পূর্বেও এইসব কথা তুলিয়া আমরা পরস্পরকে লজ্জা দিয়ে এ বিষয়ে সজ্ঞান করিবার চেষ্টা করিতাম। সেদিন এখন কাটিয়া গিয়াছে; বাংলার গ্রাম খুজিয়া, মাটি খুঁড়িয়া বাঙালিই এখন তাম্রশাসন এবং শিলালিপি বাহির করিতেছে, বাঙালি পণ্ডিত তাহার পাঠোদ্ধার ও অর্থোদ্ধার করিতেছে, বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ তাহার ঐতিহাসিক তথ্য ও মূল্য নির্ণয় করিতেছে। বাঙালি ঐতিহাসিককে বাদ দিয়া এখন আর বাংলার ইতিহাস লেখা সম্ভবপর নয়। বাংলা সাহিত্যের আকাশে যে অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে, আশা করা যায় ইতিহাসের মশাল তাহার একটা কোণ রক্তিম করিয়া রাখিবে।
আমাদের এই নবীন ইতিহাস-চৰ্চায় যাঁরা অগ্রণী তাঁরা একটা কথা খুব স্পষ্ট করিয়াই সকলকে বলিতেছেন। তাঁরা বলেন, তাঁরা যে ইতিহাস অনুসন্ধান ও রচনা করিতেছেন তাহা পুরনো ধরনের পাঁচমিশালো ঢ়িলাঢ়ালা ইতিহাস নয়। তাদের রচিত ইতিহাস ‘বিজ্ঞানসম্মত।’ ইতিহাস, এবং তাঁরা যে প্রণালীতে ঐতিহাসিক সত্যের অনুসন্ধান করেন তাহা ‘বিজ্ঞানানুমোদিত ঐতিহাসিক প্রণালী’।
ইতিহাসের সম্বন্ধে এই ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ও ‘বিজ্ঞানানুমোদিত’ প্রভৃতি বড় বড় কথাগুলির প্রকৃত অর্থটা কী তোহর আলোচনার সময় হইয়াছে। কথায় কথায় বিজ্ঞানের দোহাই দেওয়ার, আর সকলরকম বিদ্যার আলোচনাকেই বিজ্ঞান বলিয়া প্রচার করার চেষ্টা উদ্ভূত হইয়াছে গত শতাব্দীর ইউরোপের নববৈজ্ঞানিক পণ্ডিতসমাজে। ইউরোপ এখন আবার এই রোগটাকে দূর করিতে সচেষ্ট। সে দেশ হইতে বিদায় লইয়া ব্যাধিটা যাহাতে আমাদের ঘাড়ে আসিয়া না চাপে সে সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কেননা এ দেশে যা একবার আসে তা তো আর সহজে বিদায় হয় না, তা শাক-হুনই কি আর প্লেগ-ম্যালেরিয়াই কি। বিশেষত দুর্বল শরীরে সকল রকম রোগই প্রবল হইয় উঠে। আর দেহের রোগের চেয়ে মনের ব্যাধি যে বেশি মারাত্মক তাহাতেও কেহ সন্দেহ করিবেন না।
যে বিদ্যার চর্চাই করি না কেন, তাহাকে বিজ্ঞান বলিয়া প্রমাণ ও প্রকাশ করিবার ইচ্ছার নিদান হইতেছে, উনবিংশ শতাব্দীতে জড়বিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অদ্ভূত উন্নতি, আর সেই বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানকে মানুষের জীবনযাত্রার কাজে লাগাইবার চেষ্টার অপূর্ব সাফল্য। প্রথমটিতে পণ্ডিতকে মুগ্ধ করে, কিন্তু জনসাধারণকে অভিভূত করিয়াছে দ্বিতীয়টি। রেল,
আধুনিক জড়বিজ্ঞানের প্রকট মূর্তি। এমন অবস্থা বেশ কল্পনা করা যায় যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলি ঠিক আজকের অবস্থাতেই আসিয়া পৌঁছিয়াছে, কিন্তু সেগুলিকে ঘর-গৃহস্থালির কাজে লাগাইবার কোনও ব্যবস্থা করা হয় নাই। তাপ ও বাম্পের সকল ধর্মই জানা আছে, কিন্তু রেল স্টিমার তৈরি হয় নাই। তাড়িত ও চুম্বকের নিময়গুলি অজ্ঞাত নাই, কিন্তু ঘরে ঘরে বিনা তেলে আলো জ্বলে না, বিনা কুলিতে পাখা চলে না। ফ্যারাডে ও ম্যাকসওয়েল … …, কিন্তু এডিসনের জন্ম হয় নাই। যদি সত্যিই এই ঘটনাটা ঘটিত তাহা হইলে জনসাধারণের কাছে আধুনিক জড়বিজ্ঞানের আজ যে আদর ও মর্যাদা আছে তাহার কিছুই থাকিত না। এবং কি ঐতিহাসিক কি অনৈতিহাসিক জড়বিজ্ঞানের গণ্ডির বাহিরে কোনও পণ্ডিতই নিজের শাস্ত্রকে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ বলিয়া প্রচার করিবার জন্য অত ব্যস্ত হইতেন না। কারণ এই ব্যস্ততার মূলে আছে শাস্ত্রটাকে ‘বিজ্ঞান’ নাম দিয়ে জনসমাজে জড়বিজ্ঞানের প্রাপ্য যে মৰ্যাদা তাহার কিছু অংশ আকর্ষণ করিবার লোভ। নামে যে কিছু যায় আসে না’ এ কথাটা কবি বসাইয়াছেন প্রেমোন্মাদিনী কিশোরীর মুখে এবং সেইখানেই ও তত্ত্ব শোভা পায়। প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজের অর্ধেক কাজ নামের জোরেই চলিয়া যাইতেছে, এবং পণ্ডিত-সমাজকেও সে সমাজ হইতে বাদ দিবার কোনও সংগত কারণ দেখা যায় না।
নিজের শাস্ত্রকে বিজ্ঞান এবং শাস্ত্রালোচনার প্রণালীকে বৈজ্ঞানিক বলিয়া নিজের ও পরের মনকে বুঝাইবার যে ইচ্ছা তাহার আরও একটু গভীরতর কারণ কাছে। যখনই কোনও একটা বিদ্যার হঠাৎ অভূতপূর্ব উন্নতি হইয়াছে তখনই সেই বিদ্যার অনুসৃত প্রণালীটাকে সব তালার একমাত্ৰ চাবি মনে করিয়া তাহারই সাহায্যে সমস্ত শাস্ত্ৰেই সম্ভব অসম্ভব ফললাভের চেষ্টার পরিচয় ইউরোপের চিন্তার ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়াছে। দশমিক রাশির আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন গ্রিসে যখন পাটিগণিতের প্রতিষ্ঠা হইল। তখন এই রাশিক্রমটির গুণ আর শক্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতদের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। ইহাতে আশ্চৰ্য হইবারও কারণ নাই। যে গণনা মেধাবী পণ্ডিতেরও দুঃসাধ্য ছিল, ইহার বলে শিক্ষার্থী শিশুও তাঁহা অনায়াসে সমাধান করিতে লাগিল। এমন ব্যাপারে লোকের মন স্বভাবতই উৎসাহে ও আশায় চঞ্চল হইয়া উঠিবারই কথা। ফলে এই রাশিক্রমের নিয়ম ও প্ৰণালীকে সকল রকম বিদ্যায় প্রয়োগ করিয়া জ্ঞানবৃদ্ধির চেষ্টা হইতে লাগিল। এবং অবশেষে পিথাগোরাস ঠিক করিলেন যে, জগৎটা রাশিরই খেলা, রাশিক্রমেরই একটা বৃহত্তর সংস্করণ। সুতরাং এই রাশিক্রমের হেরফের আরও ভাল করিয়া করিতে পারিলে বিশ্বসংসারের কোনও তত্ত্বই অজ্ঞাত থাকিবে না। তারপর সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন বীজগণিতের প্রয়োগে জ্যামিতিশাস্ত্রের হঠাৎ আশ্চৰ্যরকম উন্নতি হইল। তখন পণ্ডিতেরা নিঃসংশয়ে স্থির করিলেন যে, জ্যামিতিক প্রণালীই সকল জ্ঞানের একমাত্র প্রণালী। অমন যে ধীর স্থির বৈদান্তিক স্পিনোজা, তিনিও তাঁর দর্শনশাস্ত্রটিকে জ্যামিতির খোলসে আবদ্ধ করিলেন। এখন সেই কঠিন খোলস অতিকষ্ট্রে সরাইয়া। তবে তাঁর চিন্তার রস গ্ৰহণ করিতে হয়। ইহার পর আসিল নিউটনের আবিষ্কৃত গণিতের পালা। নিউটন যখন তাঁর গণিতের সাহায্যে গ্ৰহ-উপগ্রহের মস্ত গতিবিধির ব্যাখ্যা প্রদান করিলেন তখন চোখের সম্মুখ হইতে যেন চিরকালের অজ্ঞানের পর্দাটা সরিয়া গেল। জাগতিক ব্যাপারের মূলসূত্রটা যে বাহির হইয়া পড়িয়াছে তাহাতে আর সন্দেহ থাকিল না। এবং কোনওরকমে এই গণিতটা প্রয়োগ করিতে পারিলেই যে সকল বিদ্যাই জ্যোতিষের মতো ধ্রুব হইয়া উঠিবে, সকলেরই এই স্থির বিশ্বাস হইল। এই বিশ্বাসের জের এখনও চলতেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও গত শতাব্দীর প্রথমে যখন তাড়িত ও চুম্বকের অনেক ঘরের কথা বাহির হইয়া পড়িল তখন আবার জ্ঞানসমুদ্রে একটা ছোটখাটো ঢেউ উঠিয়ছিল। তাড়িত ও চুম্বকের ধর্ম ও নিয়ম জগতেব সব জিনিসেই আবিষ্কৃত হইতে আরম্ভ হইল। মনের বল যে তাড়িতেরই শক্তি ইহা তো একরকম স্বতঃসিদ্ধই বোঝা গেল, এবং স্ত্রী-পুরুষ, জল-স্থল, ঠান্ডা-গরম ইত্যাদি যেখানেই জোড়া বর্তমান সেইখানেই যে চুম্বকের দুই প্রাস্তের সম্বন্ধ ও ধর্ম বিদ্যমান, এ বিষয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের কোনও সন্দেহ ছিল না। জার্মন পণ্ডিত শেলিং এই চুম্বক বেচারির উপর একটা ভারী রকমের গোটা দর্শনশাস্ত্ৰই চাপাইয়া দিলেন। বিজ্ঞা পাঠকের এরকম ছোটবড় আরও অনেক দৃষ্টান্ত মনে পড়িবে; এবং যদিও খুব ভয়ে ভয়েই বলিতেছি, আমাদের দেশে যে ত্ৰিগুণতত্ত্বের চাবি দিয়া সংসারের সকল রহস্যের দুয়ার খুলিবার চেষ্টা হইয়াছিল তাহাও আলোচ্য বিষয়ের আর-একটা উদাহরণ।