৭
বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের দিন বিগত হয়েছে। এখন যাঁরা সত্যনিষ্ঠ প্ৰামাণিক ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক বলেন তাঁরা একটা চলতি নাম অভ্যাসবিশেই ব্যবহার করেন।
কিন্তু ইতিহাসের বৈজ্ঞানিকত্ব-বিশ্বাসের একটা ফল দূর হয়নি, বেশ টিকে আছে। সে হচ্ছে ইতিহাসকে ভবিষ্যদ্ৰবক্তা মনে করা।
বিজ্ঞান ভবিষ্যতের অনেক কথা বলে। জোয়ার-ভাটার সময়, চন্দ্র-সূর্যের গ্রহণ, ভবিষ্যতের যে-কোনও দিনে গ্ৰহ-উপগ্রহের অবস্থান–গুনে বলতে পারে। যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে সেসব নিয়ম দিয়ে গণনা করে বিজ্ঞান ভবিষ্যৎ বলে। ইতিহাস যখন বিজ্ঞান তখন ইতিহাস কোন ভবিষ্যতের ঘটনা গুনে বলতে পারবে না?
অবশ্য ধরে নেওয়া হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা যেমন অনেক প্রাকৃতিক ব্যাপারের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, ঐতিহাসিকেরা ঐতিহাসিক ঘটনা পরীক্ষা করে মানুষের সমাজে ঘটনা ঘটার তেমনি সব নিয়ম আবিষ্কার করেছেন। এবং সেইসব নিয়ম অনুসরণ করে বর্তমান কোনও মানবীয় ঘটনার ভবিষ্যৎ পরিণতি। ঐতিহাসিকেরা বলতে পারেন।
বৈজ্ঞানিক লাপ্লাস নাকি বলেছিলেন যে, সৃষ্টির প্রাক্কালে পরমাণুপুঞ্জের সংস্থান কেমন ছিল, তাদের গতির দিক ও শক্তির পরিমাণ কী ছিল, তা জানা থাকলে ভবিষ্যৎ সৃষ্টির সব তথ্য তিনি গুনে বলতে পারতেন। হালের বিজ্ঞানীরা অতটা সাহসিক নন। তাঁরা জেনেছেন যে, সৃষ্টির ব্যাপার ও তার মালমশলার প্রকৃতি এরকম গণনায় ধরা দেবার মতো নয়, অনেক বেশি জটিল। মানুষের সমাজের গতি-পরিণতি তার চেয়ে কম জটিল নয়। এ জটিলতার মধ্যে ঐতিহাসিকের ভবিষ্যদবাণীর চেষ্টা যে কত নিরর্থক, গিবনের ইতিহাসে তার একটা ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে। গিবন রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস থেকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তার সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির দিকে তাকিয়েছেন। পশ্চিম-রোমান-সাম্রাজ্যের ধ্বংস ইতিহাস শেষ করে গিবন লিখছেন, ‘and we may inquire, with anxious curiosity, whether Europe is still threatened with a repetition of those calamities which formerly oppressed the aims and institutions of Rome. Perhaps the same reflections will illustrate the fall of that mighty empire and explain the probable causes of our actual security, এবং এই পরীক্ষার ফলে গিবনের মনে হয়েছে যে, তার সমসাময়িক ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা মোটামুটি দৃঢ় ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে। ‘The abuses of tyranny are restrained by the mutual influence of fear and shame; republics have acquired order and stability monarchies have imbibed the principle of freedom, or at least of moderation’ গিবন তার ইতিহাস লিখে শেষ করেন ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের দু’বছর পূর্বে। তাঁর সমসাময়িক ইউরোপীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে যে বিপ্লবের আগ্নেয়গিরির পাথর-গলা আরম্ভ হয়েছে তার কোনও সন্দেহ গিবনের মনে হয়নি।(১)
যে ঐতিহাসিকের ভবিষ্যদবক্তা হবার আকাঙক্ষণ তাঁর একবার ভেবে দেখা ভাল যে, তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টি গিবনের চেয়ে ব্যাপক ও সূক্ষ্মতর কি না। কিন্তু ভবিষ্যদবাণী উচ্চারণের উৎসাহ সে ভাবনা অনেক ঐতিহাসিককে ভাবতে দেয় না। তার এক নমুনা ইংরেজ লেখক টয়েনবি। বহু খণ্ডে তাঁর বিস্তৃত ঐতিহাসিক তত্ত্বালোচনা শেষ করে শেষ দুখণ্ডে সোজাসুজি অনেক ভবিষ্যদবাণী বলেছেন। এ কালের বিজ্ঞানীরা বলেন যে, অতি ক্ষুদ্র পরমাণুর গতিবিধি গোনা যায় না, কিন্তু পরমাণুপুঞ্জের, অর্থাৎ মাস-এর গতি-প্রকৃতি স্ট্যাটিসটিক্যাল উপায়ে গোনা যায়। টয়েনবি কোনও বিশেষ ব্যাপারের ভবিষ্যদবাণী করেননি, গোটা মানবসমাজ ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ণয় করেছেন। সে ঐতিহাসিক ভবিষ্যদবাণী ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইউরোপীয় সমাজ ও সভ্যতার ভবিষ্যতের আশা ও আকাঙ্ক্ষার ছবি– যা একজন ইউরোপীয় লেখকের মনে হয়েছে–এসব ভবিষ্যদবাণীর জন্ম এই আশা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে, ইতিহাসের কোনও শিক্ষা থেকে নয়।
৮
এ কাল পর্যন্ত মানুষের সমাজ ও সভ্যতার যতটুকু ইতিহাস জানা গেছে তাতে সে সমাজ ও সভ্যতার গতির এমন কিছু অলঙঘ্য নিয়ম কি জেনেছি। যাতে তার ভবিষ্যৎ গতির কথা কিছু বলা যায়? ইংরেজ ইতিহাস-লেখক এইচ. এ. এল. ফিশার তার ‘ইউরোপের ইতিহাস’-এর ভূমিকায় লিখেছেন, ‘One intellectual excitement has, however, been denied me. Men wiser and more learned than I have discerned in history a plot, a rhythm, predetermined pattern. These harmonies are concealed from me. I can see only one emergency following upon another as wave follows wave, only one great fact with respect tu which, since it is unique, there can be no generalizations, only one safe rule fof the historian: that he should recognize in the development of human destinies the play of the contingent and the unforeseen, This is not a doctrine of cynicism and despair. The fact of progress is written plain and large on the page of history; but progress is not a law of nature. The ground gained by one generation may be lost by the next. The thoughts of men may flow into channels which lead to disaster and barbarism.’