এসব অধ্যায়গুলি মমসেনের ইতিহাসের পরিশিষ্ট মাত্র। মূল ইতিহাসের অংশ নয়। তাঁর ইতিহাসের প্যাটার্নের পাশে বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে একটু কুননি-করা। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, সে যুগে রাষ্ট্রীয় ঘটনাই একমাত্র ঘটনা নয়, অন্য ব্যাপারও মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। মমসেন কখনও কল্পনা করেননি যে তাঁর এইসব বিবরণ সেসব যুগের ধর্ম ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পের এমন বিবরণ দিয়েছে যে এসব ব্যাপারের প্রতিটির স্বতন্ত্র ইতিহাস লেখার ও পড়ার আর প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে এসব বিষয়ের স্বতন্ত্র জ্ঞান যাদের নেই তাঁরা মমসেনের বিবরণ পড়ে কিছুই বুঝতে কি জানতে পারবে না।
মানুষকে অখণ্ড করে দেখাই তাকে সত্য করে দেখা। কিন্তু খণ্ড খণ্ড করে প্রথমে তার পরিচয় না নিলে তাকে অখণ্ড করে দেখা অসম্ভব। ‘একং বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং’ নয়, সর্বকে জানলেই তবে এককে জানা যাবে। রাষ্ট্রীয় ইতিহাস অবশ্যই দেশ ও কালের সম্পূর্ণ পরিচয় দেয় না। সে সম্পূর্ণ পরিচয়ের উপায় নয় রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসকে ফাপিয়ে মালটি-পারপাস ইতিহাসে পরিণত করা। তার উপায় দেশ ও কালের নানা ব্যাপারের স্বতন্ত্র পরিচয় দেওয়া। তার জন্য স্বতন্ত্র সব ইতিহাসের প্রয়োজন। এসব স্বতন্ত্র ইতিহাস পাঠকের মননের জারক রসে এক হয়ে তবেই দেশ ও কালের অখণ্ড পূর্ণ জ্ঞান দেয়। যে পাঠক সে শ্রম-স্বীকারে প্রস্তুত নন তার জন্য রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের সঙ্গে অন্য ইতিহাসের হ্যান্ডবুক অবশ্য জুড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সে হ্যান্ডবুকগুলি হ্যান্ডবুকই, ইতিহাস নয়।
রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের আকর্ষণ যে অন্য সবরকম ইতিহাসের আকর্ষণের চেয়ে বেশি তার কারণ, সে ইতিহাস মানুষের কর্ম-অকর্মের, সুখ-দুঃখের, মহত্ত্ব-হীনতার, দ্বন্দ্ব-মৈত্রীর, জয়-পরাজয়ের বিশিষ্ট কাহিনি। সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস, কি ধনতন্ত্রের ক্রমিক পরিবর্তনের ইতিহাসের মতো নৈর্ব্যক্তিক ব্যাপারের বিবরণ নয়। মানুষের কাছে রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের আকর্ষণ মানুষের প্রত্যক্ষ স্পর্শের আকর্ষণ। সামান্য ও বিশেষের মধ্যে বিশেষ যে বলবান, সকল বিধিনিষেধের ব্যাখ্যায় এটি একটি প্রযোজ্য নিয়ম। ইতিহাসেও অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ‘সামান্যর চেয়ে কনক্রিট ‘বিশেষ’ বলবান। তত্ত্বের মহিমা তখনই হৃদয়ঙ্গম হয় বিশিষ্ট তথ্যের মধ্যে যখন তাকে দেখা যায়।
৬
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একদল ইউরোপীয় ইতিহাস-লেখক বলতে আরম্ভ করলেন যে, ইতিহাস সাহিত্য নয়, ইতিহাস একটা বিজ্ঞান। এবং নিজেদের লেখা ইতিহাসের, পূর্বতনদের সাহিত্য-গন্ধী ইতিহাস থেকে তফাত করার জন্য, নাম দিলেন ‘বৈজ্ঞানিক ইতিহাস’–সায়েন্টিফিক হিস্টরি। সে সময় অনেক বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির কাল। কিন্তু এক বিজ্ঞানের সত্য আবিষ্কারের যা পথ ও নিয়মকানুন, অন্য বিজ্ঞানের সত্য আবিষ্কার সে পথে ও সে নিয়মকানুনে চলে না। পদার্থবিজ্ঞানের চলার রীতি ও জীবনবিজ্ঞানের চলার রীতি এক নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুশীলনের রীতি রসায়নবিজ্ঞানের অনুশীলনের রীতি নয়। সকল বিজ্ঞানের সাধারণ কোনও বৈজ্ঞানিক রীতি নেই। যা সকল বিজ্ঞানে সাধারণ সে হচ্ছে সত্যনিষ্ঠা, এবং বিনা প্রমাণে কি অপ্রচুর প্রমাণে কোনও কিছুকে সত্য বলে গ্ৰহণ না করা। এবং প্রমাণবিরুদ্ধ হলে চিরপোষিত মত ও চিন্তাধারাকে পরিত্যাগে দ্বিধাহীনতা। যে ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ প্রকৃত ইতিহাস, কল্পনাবিভ্রান্ত নয়, সে ইতিহাসে এসব গুণ অবশ্য থাকবে। অর্থাৎ সে ইতিহাস হবে প্রামাণিক ইতিহাস, বিনা প্রমাণে কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করবে না, কোনও মোহতেই প্রমাণিত সত্যকে গোপন করবে না। কিন্তু মাত্র প্রামাণিক বললে ইতিহাসকে ‘বৈজ্ঞানিক’ নাম দেওয়ার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞানের যে অসীম প্রেস্টিজ, নামের মহিমায় তার কিছুটা ইতিহাস-বিদ্যায় টানা যায় না। এমন মনোভাব ও চেষ্টা নূতন নয়। পূর্বে যখন দর্শনের প্রেস্টিজ ছিল বড়, এবং বহু বিজ্ঞানের শৈশবকাল, তখন পদার্থবিজ্ঞানের নাম ছিল ন্যাচারাল ফিলজফি। আজ সুনীতিবিদ্যাকে মর্যাল ফিলজফি না বলে বলি মর্যাল সায়েন্স।
কিন্তু ইতিহাস-রচনাকে যাঁরা বিজ্ঞান-রচনা মনে করেছিলেন, তাদের রচিত ইতিহাসে তার ফল ফলেছিল। ইতিহাস যখন বিজ্ঞান তখন সাহিত্যের মতো তার সুখপাঠ্য হওয়া দোষের, কারণ তা ভঙ্গি দিয়ে সাধারণ পাঠকের মন ভুলাবার চেষ্টা। ইতিহাস হবে বিজ্ঞানের মতো নিরেট, অর্থাৎ সলিড, এবং তাতে রসের স্পর্শ থাকবে না। সাধারণ পাঠক সে ইতিহাস নাই-বা পড়ল, কারণ সাধারণ পাঠক সচরাচর বিজ্ঞানের পুথি পড়ে না। ফলে সেসব বৈজ্ঞানিক ইতিহাস এখন অসাধারণ পাঠকও পড়ে না।
ইতিহাসের বৈজ্ঞানিকত্বের একটা সুবিধা যে, রচনাশক্তির তারতম্যে এক ঐতিহাসিক অন্য ঐতিহাসিকের চেয়ে খাটো হয় না। কেননা রচনাশক্তিটাই অবাস্তর। কোনওরকমে সত্য তথ্যটা প্রকাশ করতে পারলেই হল। এবং আরও বড় সুবিধা আছে।
ইতিহাস যখন বিজ্ঞান তখন গবেষণায় ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কারের নিয়মগুলি আয়ত্ত করে পরিশ্রম করলেই সকল ঐতিহাসিক সমান মূল্যের ইতিহাস রচনা করতে পারে। ঐতিহাসিক প্রতিভা বলে কিছু নেই। আছে নিয়ম মেনে চলা ও পরিশ্রম করা।
হাতে-হাতিয়ারে যাঁরা কোনও বিজ্ঞানের চর্চা করে না, বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে বিজ্ঞানীর মননধারার খবর জানে না, তাদের অনেকের ধারণা যে, বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার সৰ্বজনস্বীকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণার নিয়মগুলির কঠোরভাবে পালন করে পরিশ্রমনিষ্ঠার ফল। ষোড়শ শতব্দে যখন ইউরোপে নববিজ্ঞানের উন্মেষকাল, ও তার সাফল্যে সকলে চমৎকৃত, সে সময় ইংল্যান্ডের ফ্রান্সিস বেকন এ নববিদ্যার একজন উদগাতা ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Advancement of Learning-এ তিনি প্রাচীনকালের কুসংস্কার-মুক্ত সত্য আবিষ্কারের এই চেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, প্ৰাচীন মত যদি প্ৰাচীনদের মত বলে গ্রাহ্য করতে হয়, তবে আধুনিকেরাই প্রকৃত প্রাচীন, কারণ প্রাচীনদের চেয়ে আধুনিকদের বয়স অনেক বেশি। ফ্রান্সিস বেকন আর-একখানি পুথি লিখেছিলেন, যার নাম Novum Organum, অর্থাৎ সত্য আবিষ্কারের নূতন বিধিবিধান। এ গ্রন্থে বেকন বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের নিময়গুলির এক তালিকা দিয়েছেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, প্রাকৃতিক ব্যাপারের অনুশীলনে এই নিয়মগুলির প্রয়োগ করলেই সে ব্যাপারের বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার হবে। এই আশায় ওই গ্রন্থে তিনি অনেকগুলি প্রাকৃতিক ব্যাপারেরও তালিকা দিয়েছেন, যাতে বিজ্ঞানীরা গবেষণার নিয়মগুলি প্রয়োগ করে সেসব ব্যাপারের বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করতে পারে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার যে বাধাধরা নিয়ম প্রয়োগেই হয় তাতে বেকনের সন্দেহ ছিল না। অর্থাৎ নিয়ম মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে চৰ্চা করলে যে-কেউ নিউটন কি ডারউইন, আইনস্টাইন কি প্ল্যাকের তুল্যমূল্য সত্য আবিষ্কার করতে পারে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারে নবনব-উন্মেষশালী বুদ্ধির আবির্ভাব অনাবশ্যক। বিজ্ঞানোৎসাহী বেকনের বিজ্ঞানে যে অস্তদৃষ্টি ছিল না তার বড় প্রমাণ যে, ষোড়শ শতাব্দীতেও বিজ্ঞানে গণিতের স্থান সম্বন্ধে তার কোনও জ্ঞান ছিল না। বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকদেরও ধারণা বেকনের বিজ্ঞানের ধারণার অনুরূপ–যে-কোনও ইতিহাস-লেখক চেষ্টা করলেই গিবন কি মমসেন হতে পারে!