বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে শূন্যতাই সব, বস্তু নেই বললেই চলে। নীহারিকা নক্ষত্র সূর্য গ্রহ উপগ্রহ, বস্তুর দু-চারটে বিন্দু অসীম দূরে দূরে এখানে ওখানে ছড়ানো আছে। ইতিহাসের যা বস্তু তা অবস্তু ঘটনার মহাকাশে গুটি-কয়েক বিন্দু। সেই বিন্দুগুলি বেছে নিয়েই ইতিহাস রচনা হয় এবং ইতিহাস রচনা সম্ভব হয়। ইতিহাসের দেশ ও কালের সীমায় যে সংখ্যাতীত ঘটনা ঘটে তার অতি ক্ষুদ্র অংশ ইতিহাসের উপাদান। তুলনায় প্রায় সব বাদ দিতে হয়, রাখতে হয় অতি সামান্য। বাছাই করে কতটুকু রাখতে হবে নির্ভর করে ঐতিহাসিকের প্রতিভার উপর ও তার ইতিহাস রচনার লক্ষ্যের উপর।
৩
আচাৰ্য মেট্ল্যান্ড তাঁর ইংল্যান্ডের ব্যবহারশাস্ত্রের ইতিহাসে ঘটনার অবিচ্ছিন্নতাকে বলেছেন সেলাই-শূন্য ঠাসবুননি পট,–‘a seamless web’। ঐতিহাসিক এই পটে নানারঙা সুতোর সেলাই দিয়ে ইতিহাসের প্যাটার্ন তোলেন। কোনও প্যাটার্নের ঘের খুব বড়, যেমন মমসেনের জুলিয়াস সিজারের ক্ষমতালাভ পর্যন্ত রোমের রিপাবলিকের পাঁচ শতাব্দীর ইতিহাস। আরও বড় ঘের, যেমন গিবনের রোম-সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংসের ইতিহাস, মারাকাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর পর থেকে তুর্কিদের কনস্টান্টিনোপল দখল পর্যন্ত প্ৰায় তেরো শতাব্দীর ইতিহাস। কোনও ঘের তুলনায় অনেক ছোট। যেমন আচাৰ্য যদুনাথের ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস, ভারতবর্ষে মুঘল-সাম্রাজ্য ধ্বংসের সূচনার ইতিহাস। বলা বাহুল্য, এ পটের দুই ডাইমেনশন, দেশ ও কাল। কোনও ইতিহাসের ঘের কালের ডাইমেনশনে দূরপ্রবাসী ডাইমেনশনে তুলনায় ছোট—যেমন ইতিহাসের প্রকৃত আরম্ভ থেকে আলেকজেন্ডারের মৃত্যু পর্যন্ত তিনশো বছরের গ্রিসের ইতিহাস। দেশের ডাইমেনশনে প্ৰকাণ্ড, কালের ডাইমেনশনে অত্যন্ত খাটো— যেমন পৃথিবীর বহু অংশে ব্যাপ্ত বিগত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পাঁচ বছরের ইতিহাস। ইতিহাসের ঘের কালে ও দেশে। কত বড়, কি কত ছোট হবে, তার কোনও স্বাভাবিক মাপ নেই। সে মাপ নির্ভর করে ঐতিহাসিক কতটা কালের ও কতখানি দেশের কথা বলতে চান। গত মহাযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহাসিক যুদ্ধারম্ভ থেকে যুদ্ধ বিরতি পর্যন্ত লিখতে পারেন। কিন্তু সে মহাযুদ্ধের প্রকট ফলাফলও যুদ্ধবিরতিতেই শেষ হয়নি। তার সংঘাতে পৃথিবীর নানা খণ্ডে মানুষের মধ্যে ভাঙাগড়া আজও চলছে। ঐতিহাসিক এ মহাযুদ্ধের ইতিহাসে তার সময় পর্যন্ত পৃথিবীর নানা খণ্ডে এই ভাঙা-গড়ার বিবরণ তার ইতিহাসের অন্তর্গত করতে পারেন। অথবা একটিমাত্র দেশে, যেমন ইংল্যান্ডে কি মার্কিন দেশে, তার ফলাফলের বিবরণে ইতিহাস শেষ করতে পারেন। দেশ ও কাল মানুষের মনের সৃষ্টি কি না দার্শনিকেরা তার বিচার করেন। কিন্তু ইতিহাসের দেশ ও কাল যে ঐতিহাসিকের মনের সৃষ্টি তাতে সন্দেহ নেই।
8
দেশ ও কালের ঘেরের মধ্যে ঐতিহাসিক ইতিহাসের যে প্যাটার্ন বোনেন সে প্যাটার্ন কত চওড়া? তার মাপ নির্ভর করে প্রথমত ও প্রধানত, ঐতিহাসিক যে ধরনের ইতিহাস রচনা করেন, ওই নির্দিষ্ট দেশ ও কালে সে ইতিহাসের উপযোগী ও প্রাসঙ্গিক ঘটনার বহুলতা বা বিরলতার উপর এবং সেসব ঘটনার জ্ঞানের প্রাচুর্য বা দৈন্যের উপর। মগধ-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকে হর্ষবর্ধনের মৃত্যু পর্যন্ত উত্তর-ভারতবর্ষের রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের যে চওড়া প্যাটার্ন তার তুলনায় বৈদিক যুগ থেকে মগধসাম্রাজ্য স্থাপনের পূর্বকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের প্যাটার্ন অত্যন্ত সরু, এবং তা হবেই হবে। ওই প্ৰাচীনতর কালের রাষ্ট্রীয় ঘটনার জ্ঞান যে তুলনায় খুব বিরল কেবল তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের উপযোগী ও প্রাসঙ্গিক ঘটনাই ঘটেছিল অত্যন্ত অল্প। লোকের জীবনে রাষ্ট্রীয় ঘটনার প্রভাব ও প্রাধান্য ছিল কম, কারণ রাষ্ট্রগুলি ছিল শিথিলবন্ধন। সম্ভব অনুসন্ধানের ফলে এ যুগের রাষ্ট্ৰীয় ঘটনার জ্ঞান ক্ৰমে অনেক বাড়বে, কিন্তু সে জ্ঞান প্রধানত হবে বিচ্ছিন্ন সব রাষ্ট্রের রাষ্ট্ৰীয় ঘটনার জ্ঞান। এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে অল্পবিস্তর ধারাবাহিক ঘটনার সুতোয় বেঁধে ইতিহাসের প্যাটার্ন বোনা সম্ভব হবে, সে ভরসা করতে সাহস হয় না। কিন্তু প্ৰাচীনতর কালের জ্ঞান, কি ভারতবর্ষে কি অন্য দেশে, বেশির ভাগ এইরকম বিচ্ছিন্ন জ্ঞান। মানবীয় ঘটনার বিচ্ছিন্ন জ্ঞানের আবিষ্কারকে প্রত্নতত্ত্ব নাম দিয়ে তাদের কেবল ইতিহাসের মালমশলা মনে করা সত্যদৃষ্টি নয়। যে নূতন আবিষ্কৃত জ্ঞানের পূর্ব থেকে জ্ঞাত ঘটনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়, সে জ্ঞান ইতিহাসের মালমশলা। কারণ সে জ্ঞান ইতিহাসের প্যাটার্নকে আর-একটু বেশি চওড়া করে, অথবা ফাক পূর্ণ করে সে প্যাটার্নের কুননিকে আরও একটু ঠাসবুননি করে। কিন্তু যে জ্ঞানের এরকম সংযোগ স্থাপন করা যায় না, যা বিচ্ছিন্নই থেকে যায়, সে জ্ঞান মূল্যহীন নয়। মানুষের পরিচয় দেয় বলেই মানুষের কাছে তার মূল্য। মহেঞ্জোদাড়ো কি ক্রীটের মাটি খুঁড়ে মানুষের যেসব চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছে সেসব মানুষের সঙ্গে ভারতবর্ষের কি ভূমধ্যসাগরের সভ্যতার ইতিহাসের স্পষ্ট যোগ স্থাপন করা যায়নি। এবং কোনওদিন যদি নাও যায়, মানুষের এই পরিচয় মানুষের বিস্ময় জাগাবেই। সে বিস্ময় ইতিহাস যে বিস্ময় জাগায় তার সমগোত্র। শেলির Ozymandias-এর এর মতো–