গত তেসরা ফাল্গুন অশোককে নিয়ে আমি আর মমতা সান্ধ্যভ্রমণে বেরুই। তুমি জানো, এটি আমার পুরোনো অভ্যাস। ছেলেবেলায় তুমিও আমার সঙ্গে রোজ বেড়াতে বেরুতে।
অশোক বাগানের এদিকে-ওদিকে ছুটোছুটি করে আপন মনে খেলা করছিল, মমতা আর আমি বসেছিলুম একখানি বেঞ্চিতে।
সন্ধ্যা যখন হয় হয়, তখন আমরা বাড়ি ফেরবার জন্যে গাত্রোত্থান করলুম। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও অশোকের সাড়া পাওয়া গেল না।
তখন ভয় পেয়ে আমরা চারদিকে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলুম। অনেকক্ষণ পরে রাতের অন্ধকার যখন জমাট হয়ে উঠেছে, তখন বাগানের বাইরে একটি ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেল অশোকের মৃতদেহ। কোনও পিশাচের কঠিন আঙুলের ছাপ তখনও তার কণ্ঠের ওপরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
অশোকের দেহের পাশে পড়েছিল একখানা খণ্ড খণ্ড ফটোগ্রাফ। সেখানা তোমারই ছবি—তোমার যাওয়ার আগের দিনে যা তোলা হয়েছিল।
ছবিখানা তোমার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ছিল, ঘটনাস্থলে কেমন করে এল প্রথমটা তা বুঝতে পারিনি। তারপর আন্দাজ করেছি, শিশু-বুদ্ধির কোনও খেয়ালে অশোক বেড়াতে যাওয়ার সময়ে ছবিখানা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছবিখানা এমন খণ্ডখণ্ড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে কেন, তার কারণ আমি জানি না।পুলিশ তদন্ত আরম্ভ করেছে, কিন্তু এখনও খুনির কোনও সন্ধানই পাওয়া যায়নি। এবং এই শিশুহত্যার উদ্দেশ্যই বা কী তাও কেউ অনুমান করতে পারছে না।
তোমার মা পরলোকে গিয়ে এই দারুণ আঘাতের ব্যথা থেকে মুক্তিলাভ করেছেন বটে, কিন্তু মমতাকে নিয়ে আমি বিব্রত হয়ে পড়েছি। অশোকের মায়ের স্থান নিয়েছিল মমতাই, তাকে হারিয়ে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। সে দিনরাত কাদছে আর ঘনঘন মূৰ্ছা যাচ্ছে। মমতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি আমার নেই।
অজয়, পত্রে আমি এর বেশি আর কিছু লিখতে চাই না—লেখবার শক্তিও আমার নেই। নিজেকে বড়োই একাকী বলে মনে করছি। এখন তোমাকে আমার কাছে পেতে চাই। ইতি—
তোমার হতভাগ্য পিতা
সেইদিনই প্রণবের সঙ্গে দেশের দিকে যাত্রা করলুম।
আবার দুঃস্বপ্ন
দেশে এসেছি।
আমাদের শোকাচ্ছন্ন পরিবারের দুঃখ-দুর্ভাগ্যের কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করে আমার আসল বক্তব্যকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। দুনিয়ার এমন কে মানুষ আছে, শোক-দুঃখের আস্বাদ যে পায়নি? এক্ষেত্রে মানুষ মাত্রই ভুক্তভোগী। সুতরাং আমার একান্ত সাধারণ অশ্রুজলের কাহিনি এবং প্রিয়বিয়োগকাতর আত্মীয়স্বজনের হা-হুতাশের ইতিহাস বর্ণনা করলেও আপনি অনায়াসেই অনুভব করতে পারবেন।
একে দীর্ঘকালব্যাপী রোগশয্যা থেকে উঠেই ভগ্নদেহে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি, তার ওপরে বাড়ির ভেতরকার এই বুকচাপা আবহ;—প্রাণ-মন যেন শ্রান্ত হয়ে পড়ল। ছোটো ভাইকে আমি যে ভালোবাসতুম না, তা নয়; অশোক ছিল আমার আত্মার মতন প্রিয়। কিন্তু যতই কাঁদি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি, সে আর ফিরবে না। নিয়তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লাভ নেই।
শোকের চেয়ে আমার মনে প্রবল হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসার ভাব। অতটুকু নিষ্পাপ অবোধ শিশু—পৃথিবীতে ছিল যে স্বর্গের প্রতিনিধির মতো, কোন পাষণ্ড তাকে অকারণে হত্যা করলে? এ যেন কেবল হত্যার আনন্দ উপভোগ করবার জন্যেই হত্যা করা এত বড়ো নরাধম যে এখনও ধরা পড়ল না, সে যে এখনও সমাজে-সংসারে সাধুর মুখোশ পরে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, এই ভেবেই আমার আক্রোশ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে লাগল।
দিনরাত কেবল ওই কথাই ভাবি। শিশু-রক্তে হাত রাঙা করে কোথায় সে লুকিয়ে আছে? কে তার সন্ধান দেবে? কোন কৌশলে তাকে ধরা যায়?
ভগ্ন দেহের দুঃখ, বাবার ও মমতার শোক-অধীর মুখ, হত্যাকারীর বিরুদ্ধে অশান্ত জল্পনা-কল্পনা ক্রমেই আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। তাই একদিন মনকে একটু ছুটি দেওয়ার জন্যে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লুম।
পশ্চিমের যে ছোটো শহরটিতে আমার বাড়ি, তার সীমানা পার হলেই দেখা যায় চারদিকে পাহাড়, ঝরনা, বন, মাঠ আর নদী। প্রকৃতিকে চিরদিন আমি ভালোবাসি, তার কোলে গিয়ে দাঁড়ালে কেবল সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য নয়, লাভ করি সান্ত্বনার আশীর্বাদও।
ভুট্টাখেতের পর ভুট্টাখেত—সেখানে দিকে দিকে বসেছে পাখিদের ভোজসভা। সুদূরের নীল অরণ্যের এপারে পড়ে রয়েছে অসমোচ্চ প্রান্তর এবং তারই ভেতর দিয়ে একেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির রৌপ্য-ধমনির মতন একটি ছোট্ট নদী।
সামনেই একটি পাহাড়। তারই পদতলে চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম, আজকের বিদায় লগ্নে পশ্চিম আকাশের পটে রঙিন ছবি আঁকবার জন্যে সূর্য কোন কোন রঙের ডালা নিয়ে বসেছে।
কিন্তু আর একদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলুম, সূর্যের চিত্রলেখা মুছে দেওয়ার জন্যে দ্রুত ধেয়ে আসছে মস্ত একখানা কালো মেঘ। দেখতে দেখতে বজ্র-বাজনা বাজাতে বাজাতে সেই বিদ্যুভরা মেঘখানা প্রায় সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল ব্লটিং কাগজের ওপরে ওলটানো দোয়াতের কালির মতো।
বহুদূর থেকে আগতপ্রায় ঝটিকার চিৎকার শুনতে পেলুম। তারপর হয়তো বৃষ্টিও আসবে।
এখানকার সমস্তই আমার নখদর্পণে। বাল্যকালে এই মাঠে, নদীর ধারে ও পাহাড়ের বুকে কত খেলাই করেছি। শ-দেড়েক ফুট ওপরে পাহাড়ের এক জায়গায় একটি গুহা আছে তাও আমি ভুলিনি। আসন্ন ঝড়-বৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলুম।