নিশ্চয় আমি পাগল! দানবের কাছে অঙ্গীকার! এর কোনোই মূল্য নেই।
তখনই ঝড়ের মতন ছুটে আবার গুহার ভেতরে গিয়ে ঢুকলুম। টেবিলের ওপরে শুয়েছিল দানবীর বিপুল মূর্তি—কিন্তু তখনও জীবনহীন। একটা প্রকাণ্ড হাতুড়ি নিয়ে আমি তখনই নিজের হাতে যত্নে গড়া সেই মূর্তিকে করলুম খণ্ড-বিখণ্ড।
তারপরেই পিছনে শুনলুম একটা ভয়াবহ চিঙ্কার। ফিরেই দেখি, দানব এসে দাঁড়িয়েছে আমার সম্মুখেই।
মেঘের মতন গম্ভীর কণ্ঠে সে বললে, আমার সঙ্গীর মূর্তি তুমি ভেঙে ফেললে! তোমার ইচ্ছেটা কী শুনি? তুমি কি তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে চাও? সারাজীবন আমি কষ্ট স্বীকার করে এসেছি—কেবল তোমার খেয়ালের জন্যেই! এত যাতনার পর তুমি কি আমার শেষ আশার বাতিও নিবিয়ে দিতে চাও?
প্রচণ্ড ক্রোধে পাগলের মতন হয়ে আমি চিৎকার করে বলে উঠলুম, দূর হ, দূর হ! পৃথিবীকে—মানুষ জাতিকে ধ্বংস করবার জন্যে আবার আমি তোর মতন কিংবা তোর চেয়ে একটা সৃষ্টিছাড়া মূর্তিকে সৃষ্টি করব? দূর হ, দূর হয়।
দানবের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল ভীষণ এক উত্তেজনায়—তার দেহ হঠাৎ হয়ে উঠল। সোজা, তার দুই হাত হল মুষ্টিবদ্ধ। মনে হল সে আমায় আক্রমণ করতে চায়। কিন্তু কোনওরকমে সে ভাব সামলে দানব বললে, গোলাম, দেখছি তোমার কাছে যুক্তির বা। প্রতিজ্ঞার কোনোই মূল্য নেই! উত্তম! শক্তিমান হচ্ছি আমিই! তোমাকে আমি খণ্ডবিখণ্ড করে লুপ্ত করতে পারি! তুমি নাকি আমার সৃষ্টিকর্তা? কিন্তু আজ আমিই তোমার প্রভু! পালন করো আমার হুকুম। ভাবছ আমার চেয়েও তুমি হতভাগ্য? কিন্তু তোমাকে আমি দুর্ভাগ্যের এমন চরম সীমায় নিয়ে যেতে পারি, যেখানে গিয়ে তুমি ভাববে সূর্যের পবিত্র আলোকও ঘৃণাকর!
আমি হা হা করে হেসে বলে উঠলুম, চমৎকার! যা খুশি বলতে চাও, বলো—আৰ আমি অস্থির হব না! তুই আমাকে ভয় দেখাতে চাস? কিন্তু আমি ভয় পাব না, আমি মানুষদের ধ্বংস করবার জন্যে তোর মতন আর দ্বিতীয় মূর্তি সৃষ্টি করব না-দূর হ এখান থেকে তোর গর্জন বা অনুরোধ, কিছুই আমাকে সংসারচ্যুত করতে পারবে না!
রাক্ষসের মুখ-চোখ যেরকম করে উঠল, ভাযায় তা বর্ণনা করা যায় না। আমি ভাবলুম, সে বুঝি আমায় আক্রমণ করবে! কিন্তু সে কোনওরকমে আবার নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, আমি সব খবর রাখি! তুমিও এত সঙ্গী থাকতে আবার বিয়ে করবে? পশুরও সঙ্গী আছে! আর আমি একলাই কেবল সঙ্গীহীন হয়ে এই পৃথিবীর মরুভূমির ওপরে পাগলের মতন ছুটে বেড়াব? ধিক তোমাকে!.এর পরে আর আমাকে কোনও দোষ দিয়ো না। মানুষ! আমি তোমায় ঘৃণা করি! আমি নরকের আগুনে জ্বলব, আর তুমি পরম সুখে জীবন যাপন করবে? কখনও নয়, কখনও নয়। আমি তো একদিন মরবই—কিন্তু তার আগে তোমায় মারব! আজ থেকে গোখরো সাপের মতন তোমার ওপর দৃষ্টি রাখব, তারপর দংশন করব একদিন। মানুষ! তোমাকে আমি শিক্ষা দেব!
তার বড়াই শুনে আমার রাগ আরও বেড়ে উঠল। চিৎকার করে বললুম, শয়তান, চুপ। কর! আর এখানকার বাতাসকে বিষাক্ত করিসনি। যা বলবার, আমি তা বলেছি। তোর কথায় আর আমি মত বদলাব না। চলে যা এখান থেকে!
বেশ, বেশ। তাহলে এই কথাই রইল। আমি আবার আসব তোমার বিবাহের রাত্রে।
আমি উন্মত্তের মতো তার দিকে ছুটে গেলুম, কিন্তু তাকে ধরতে পারলুম না। চেঁচিয়ে বলে উঠলুম, তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? তার আগে ভেবে দ্যাখ, তুই নিজেই নিরাপদ কিনা!
কিন্তু কার সঙ্গে আমি কথা কইছি? আমি কিছু বলবার আগেই দানবের মূর্তি হয়েছে। অদৃশ্য!
চারদিক আবার চুপচাপ। নিষ্ফল আক্রোশে আমি গুহার ভেতরে পায়চারি করতে লাগলুম।
যদি তাকে ধরতে পারতাম! কেন তাকে পালাতে দিলুম? কেন লোহার ডান্ডা মেরে গুঁড়িয়ে দিলুম না তার মাথাটা!
আমার বিবাহের রাত্রে আবার তার আবির্ভাব হবে! তার মানে, সেইদিনই সে আমাকে হত্যা করবে। তার বউ জুটল না, অথচ আমি বিবাহ করব- এই হচ্ছে তার অভিযোেগ! কী স্পর্ধা! সে কি ভাবছে তার মতন একটা জন্তুর ভয়ে আমি বিবাহ করব না? দেখা যাক।
পরদিন দু-খানি পত্ৰ পেলুম। একখানি প্রণবের, একখানি বাবার।
প্রণব জানিয়েছে, অনেকদিন আমাকে না দেখে তার মন কেমন করছে, তাই খুব শীঘ্রই এখানে এসে হাজির হবে।
বাবা জানিয়েছেন, দুই মাস পূর্ণ হতে আর দেরি নেই। অতএব পরের মাসের দশ তারিখে তিনি আমার বিবাহের দিন ধার্য করতে চান।
পত্রোত্তরে বাবাকে আমার সম্মতি জানালাম। কিন্তু সম্মতি জানাবার সময় এ কথাও মনে হল, বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পান দানবের কথা, তাহলে আর কি ওই তারিখে আমার বিবাহ দিতে চাইবেন?
দিন-তিনেক কেটে গেল নানা দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে। তারপর এ জায়গাটা আর ভালো লাগল না-দানবের আবির্ভাবের পর থেকেই এখানকার বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে! স্থির করলুম, আবার দেশে ফিরে যাব। কিন্তু তার আগে একটা কাজ শেষ করে যেতেই হবে।
গুহার ভেতরে এখনও পড়ে আছে দানবী মূর্তিটার ধ্বংসাবশেষ। আমি চলে যাওয়ার পর যদি কেউ এই দেহাবশেষ আবিষ্কার করে তবে বিশেষ গোলমাল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। তার ফলে নানা খবরের কাগজে রাক্ষসী হত্যা নিয়ে হরেকরকম চমকদার গল্প পর্যন্ত প্রকাশিত হতে পারে।
সে অভিশপ্ত গুহার ভেতরে আর ঢােকবার ইচ্ছা হচ্ছিল না। তবু কোনওরকমে বিদ্রোহী মনকে সংযত করে আবার গুহার মধ্যে প্রবেশ করলুম।