মাত্র দুই মাস সময়। এর মধ্যেই করতে হবে আমাকে একটি দানব-মূর্তি সৃষ্টি। সুকঠিন কর্তব্য, কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ এবারে আমাকে আর অন্ধের মতো অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে না। পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলেই এবারে আমি খুব তাড়াতাড়ি জাক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে পারব!
দানবী
বিন্ধ্য পাহাড়ের এই নির্জনতাই হচ্ছে আমার ভূতুড়ে কাজের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। এখানে কৌতূহলী দৃষ্টির উৎপাত নেই।
বাংলো থেকে খানিক তফাতে ছিল একটি অন্ধকার গভীর গুহা। নানা জায়গা থেকে গোপনে আমার অপার্থিব মূর্তি গঠনের নানা উপাদান একে একে এনে ওহার ভেতরে জড়ো করতে লাগলুম। এই উদ্যোগ-পর্বই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার এবং এই কাজ শেষ করতেই কেটে গেল পনেরো দিন।
তারপর আরম্ভ হল গঠন কার্য। প্রথম প্রথম এই বিশ্রী কাজে কিছুতেই মন বসতে চাইত। যে অপূর্ব মরীচিকা আগের বারে আমাকে জগৎ ভুলিয়ে তার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, এবারে তেমন কোনও আকর্ষণ নেই। আমি কাজে হাত দিয়েছি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।
কিন্তু আর এক প্রকাণ্ড মূর্তির কাঠামো যখন কতকটা তৈরি হল, আবার আমি নিজেকে ভুলে গেলুম। বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো ভুলে গেলুম আমি নিখিল বিশ্ব! কাজের মধ্যে ড়ুবে কোনওদিন আঠারো এবং কোনওদিন বা উনিশ-কুড়ি ঘণ্টা কোথা দিয়ে যে কেটে যেতে লাগল, কিছুই বুঝতে পারতুম না। দেখতে দেখতে দানবীর কাঠামো সম্পূর্ণ আকার ধারণ করলে।
কিন্তু মূর্তি গঠন তো তুচ্ছ ব্যাপার, যে কোনও সাধারণ কারিগর অনায়াসেই যে কোনও মূর্তি গড়তে পারে। যার মধ্যে জীবন নেই তা গড়া তো সহজসাধ্য ব্যাপার! আমাকে আনতে হবে জীবনের গতি, চাঞ্চল্য, তপ্ততা—আসল সমস্যা হচ্ছে এইখানেই।
হাতে সময় আছে মাত্র পনেরো দিন—তারপরেই পিতৃকৃত্য পালনের জন্য আমাকে যাত্রা করতে হবে নিজের দেশে। বাবাকে যখন কথা দিয়েছি, সে কথা আমি রাখব। বিবাহ করব।
একদিন মূর্তির হৃৎপিণ্ড রচনায় একাগ্রমনে নিযুক্ত হয়ে আছি, আচম্বিতে গুহার একমাত্র প্রবেশ পথে পড়ল যেন কার বৃহৎ ছায়া। আমি কৃত্রিম আলোতে কাজ করতুম—বাইরের স্বাভাবিক আলোকের কতকটা উজ্জ্বলতা আসত কেবল গুহার প্রবেশ পথ দিয়েই। সেখানটা অন্ধকার হতেই আমি চমকে ফিরে দেখলুম। একখানা অতি বীভৎস প্রকাণ্ড সুখ সাঁৎ করে সেখান থেকে সরে গেল।
হুঁ! তাহলে দানবটা এখনও আমার ওপরে তার সজাগ দৃষ্টির পাহারা জাগিয়ে রেখেছে। তাহলে আমি হচ্ছি তার হুকুমের চাকর আর সে আড়াল থেকে দেখছে আমি তার হুকুম তামিল করছি কি না! তাহলে আমি এখন বিজ্ঞানের ছাত্র নেই, একটা অমানুষের খেয়াল চরিতার্থ করবার যন্ত্র মাত্র!
তখনই স্বপ্ন ছুটে গেল! আর কাজ করতে ভালো লাগল না। গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়লুম।
বাইরে গিয়ে কিন্তু জনপ্রাণীকে দেখতে পেলুম না। সূর্য অস্ত যাওয়ার আয়োজন করছে—পশ্চিম আকাশে বিচিত্র রঙের প্রদর্শনী শুরু হতে আর দেরি নেই।
দূরে গঙ্গার ওপরে নীলাকাশে শুভ্র বেলফুলের মালার মতন বকের সারি উড়ে যাচ্ছে। কোন বনে কোন তরুকুঞ্জে রাতের বাসার সন্ধানে।
একখানা পাথরের ওপরে বসে পড়লুম, হঠাৎ মনে জাগল এক নতুন ভাবনা।
একদিন মনের ভুলে জ্ঞানান্ধ হয়ে গড়েছিলুম এক ভীষণ দানব-যে আজ আমার সমস্ত জীবনকে করে তুলেছে দুঃস্বপ্নময়! আমার সহোদর—এতটুকু শিশু অশোক পর্যন্ত যার হিংসার চিতায় করেছে আত্মদান!
আজ আমি আবার তারই জন্যে তৈরি করতে বসেছি নতুন এক দানবীর দেহ। কারণ তার দাবি, এই দানবী তার দোসর হবে!
সে প্রতিজ্ঞা করেছে, দানবীকে লাভ করলে আর মানুষের কাছে ফিরে আসবে না। দানবের প্রতিজ্ঞার মূল্য থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে।
কিন্তু আজ যে দানবীকে গড়ছি, তার প্রকৃতি কীরকম হবে আমি তা জানি না। হয়তো সে হবে দানবের চেয়ে ঢের বেশি মারাত্মক, ঢের বেশি হিংস্র। সে আমার কাছে কোনও প্রতিজ্ঞার বন্ধনে বাঁধা থাকবে না। দানবী যদি মানুষের শত্রু হয়, আমি তাকে কেমন করে নিবারণ করব?
কুৎসিত হলেই সে কুৎসিতকে পছন্দ করবে, এমন কোনও কথা নেই। হয়ত দানবী পছন্দ করবে না দানবকে। তখন দুজনেই ধেয়ে আসবে হয়তো মানুষের দেশে, নিজেদের হিংস্র প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্যে।
কিন্তু তার ওপরেও দুশ্চিন্তার কারণ আছে। এই দানব আর দানবীর সন্তান হবে— তারপর বছরে বছরে জন্মগ্রহণ করবে তাদেরও বংশধর এবং তারা কেউ হবে না আমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভবিষ্যতে দলে দলে দানব-দানবী এসে যদি মানুষদের আক্রমণ করে— চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয় ধ্বংস আর মৃত্যু, কে তখন তাদের বাধা দেবে? হয়তো একদিন তারা পৃথিবী থেকে মানুষ-জাতির অস্তিত্বই বিলুপ্ত করে দেবে।
দানবের কবল থেকে মুক্তিলাভ করবার জন্যে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে শেষটা কি আমাকেই হতে হবে মানুষ-জাতির ধ্বংসের কারণ? তখন যে আমার ধিক্কারনিনাদে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস হয়ে উঠবে শব্দিত! ভাবতে ভাবতে আমি শিউরে উঠলুম!
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ তুলে দেখলুম, পূর্ণিমার আলো ঝকমক করছে চারদিকে।
কিন্তু সেই সমুজ্জ্বল জ্যোৎস্লা তখনই পরিম্লান হয়ে গেল—যখন দেখলুম একটা অতিকায় মূর্তি আমায় লক্ষ করতে করতে হঠাৎ পাহাড়ের একটা শিখরের আড়ালে হল অদৃশ্য!
তাহলে দানবও আমায় বিশ্বাস করে না! নইলে কেন এত লুকোচুরি? নিশ্চয় তার অবিশ্বাসের মূলে আছে কূর কপটতা! সে আমায় পেয়েছে তার হাতের খেলনা। দানবীকে লাভ করলেই ধারণ করবে নিজের বিভীষণ মৃর্তি! তখন আমি তো মরবই—সঙ্গে সঙ্গে মরবে নির্দোষ মানুষরাও!