সমস্ত মধুর অনুভূতি আমার লুপ্ত হয়ে গেল। আমার কাছে সূর্য উত্তাপহীন, চন্দ্র জ্যোৎস্নাহীন, আকাশ নীলিমাহীন, পুষ্পলতা বর্ণহীন। সারা পৃথিবীকে আমি দি অভিশাপেরপর-অভিশাপ! দেহের ভেতরে সর্বদাই জাগে জ্বরের জ্বালা, মনের ভেতরে সর্বদাই মাথা খোড়ে অপরিতৃপ্ত প্রতিহিংসার নিষ্ফল আক্রোশ, দৃষ্টি দেখে সর্বদাই ধ্বংসের উৎসব! আমার স্বভাবের সমস্ত সৎগুণ নষ্ট হয়ে গেল—দিনে দিনে আমি হয়ে উঠলুম দানবেরও পক্ষে ভীতিকর মহাদানব!
একদিন এক জায়গায় আমি ভুল করে একটু সকাল সকাল—অর্থাৎ সন্ধ্যার একটু আগে পথে বেরিয়েছিলুম। জায়গাটি নির্জন ছিল বলে ভেবেছিলুম, হয়তো ঘৃণ্য মানুষের সঙ্গে দেখা হবে না।
নদীর ধারে দেখলুম একটি বাগানের মতন রঙিন ঠাঁই। প্রভু, তুমি আমাকে মানুষ করে গড়োনি, কিন্তু আমার বুকে দিয়েছ দুর্বল মানুষের মন। সেদিনের সবে ওঠা চাদ, সুগন্ধ বাতাস আর নদীর কলতান মুহূর্তের জন্যে আমার মনকে করলে অভিভূত। হঠাৎ ক্ষণিকের জন্যে পৃথিবীকে কেমন মিষ্টি লাগল।
পৃথিবীকে মিষ্টি লাগার ফুল কিন্তু ভালো হল না। আমি বরাবরই লক্ষ করে দেখেছি এমন বিকৃত কৃত্রিম ভাবের মধ্যে আমার জন্ম যে, মনের মধ্যে মাধুর্য এলেই আমাকে পেতে হয় দুর্ভাগ্যের আঘাত!
একটা ঝোপের পাশে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ালুম, এমন সুন্দর সন্ধ্যায় মানুষরা কী করছে দেখবার জন্যে।
হঠাৎ একটি ছোট্ট খোকা খেলা করতে করতে আমার সামনে ছুটে এল।
ভাবলুম, এই তো অবোধ শিশু,,এর বুকের ভেতরে হয়তো এখনও মানুষী-ঘৃণার জন্ম হয়নি, একে একটু আদর করি।
আমি শিশুর হাত চেপে ধরতেই সে মহা ভয়ে চেঁচিয়ে বলল, ভূত! রাক্ষস! ছেড়ে দে—ছেড়ে দে আমাকে। তার হাত থেকে একখানা ছবি মাটির ওপর্কে পড়ে গেল।
ছবিখানার দিকে চোখ পড়তেই চিনলুম, তাতে রয়েছে তোমার মূর্তি! হ্যা, তোমার আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রুর মূর্তি! পরমুহূর্তে আমার মন থেকে সমস্ত মধুর দুর্বলতা মুছে গেল—আবার ফিরে এল আমার দানবত্ব!
কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করলুম, ওখানা কার ছবি?
শিশু ছটফট করতে করতে বললে, আমার দাদার ছেড়ে দে আমাকে,নইলে বাবাকে ডাকব?
আমার চিরশত্রুর ভাই এই শিশু! নিজের অজ্ঞাতসারেই তার কণ্ঠের ওপরে আমার হাতের চাপ কঠিন হয়ে উঠল, তারপর শিশুর মৃতদেহ পড়ল আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে!
সেই শিশুর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে অনুভব করলুম নরকের প্রচণ্ড উৎসব। দুই হাতে তালি দিয়ে বিপুল আনন্দে বলে উঠলুম, আমিও তাহলে ধ্বংস করতে পারি! শত্রু তাহলে আমার নাগালের বাইরে নেই—এই শিশুর মৃত্যুই এ সত্য তাকে বুঝিয়ে দেবে। এর পরেও তার জন্যে তোলা রইল আরও অনেক শাস্তি। তারপর শত্রু নিপাত।
তারপর কিছুকাল আমি আর সে দেশ ত্যাগ করলুম না। কারণ আমার মন বললে, এইখানেই আবার আমার নির্দয়, নির্বোধ সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
মন ভুল বলেনি। একদিন তোমার দেখাও পেলুম। কিন্তু সেদিন আমি তোমার সামনে যাইনি।
তবে তারপর আর তোমাকে আমার চোখের আড়ালে যেতে দিইনি। দিন-রাত আড়াল থেকে রেখেছি তোমার গতিবিধির ওপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টি!
কেন? সেই কথা বলবার জন্যেই আবার এসেছি তোমার কাছে। প্রভু, এই শিশুহত্যা– অর্থাৎ আমার এই প্রথম অপরাধটাই হয়তো তোমার কাছে বড়ো হয়ে উঠবে! কিন্তু এটাকে বড়ো করে দেখবার আগে বিচার কোরো, আমাকে সহ্য করতে হয়েছে কতখানি! তুমি, আমাকে সৃষ্টি করে নিক্ষেপ করেছ আগ্নেয়গিরির গর্ভে!
তোমাকে দোয সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার জন্যেই আবার তোমার কাছে এসেছি। এখন আমার প্রার্থনা পূর্ণ করো। যতক্ষণ না আমার অনুরোধ রক্ষা করবে, ততক্ষণ আমি এ স্থান ত্যাগ করব না। মনে রেখো, এটা কেবল মিনতি নয়, তোমার দয়ার ওপরে আমার দাবি আছে!
দানবের আবেদন
নিজের কাহিনি শেষ করে দৈত্য আমার পানে তাকিয়ে রইল মৌনমুখে।
আমিও নিরুত্তর হয়ে রইলুম। তার দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আমাকে এতখানি অভিভূত করেছিল যে আমি জবাব দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলুম না।
দৈত্য বলল, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ মনুষ্য-সমাজের মধ্যে। কিন্তু কোনও মানুষই আমার সঙ্গী হতে রাজি নয়। তাই দুনিয়ায় আমি একা। তোমাকে এই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে।
জানতে চাইলুম, কেমন করে?
আমারই মতন ভয়াবহ এক নারী সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের মতন সে আমাকে কখনওই ঘৃণা করবে না–আমার বউ হতে রাজি হবে। তাহলেই একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তিলাভ করব।
তার এই প্রস্তাব শুনে আবার জেগে উঠল আমার ক্রোধ। বললুম, অসম্ভব! আমি সৃষ্টি করব তোর মতন আবার এক দানবী, আর তারপর তোরা দুজনে মিলে করবি মানুষের ওপর অত্যাচার? না, তা হবে না! দূর হ!
দৈত্য অবিচলিত কণ্ঠে বললে, প্রভু, তুমি ভুল বুঝেছ। আমার ওপরে সবাই অত্যাচার করে বলেই আজ আমি হিংসুক হয়েছি। এমনকি তুমি পর্যন্ত আমার প্রতি বিমুখ—অথচ আমি হচ্ছি তোমারই সৃষ্টি! আমার কথা যদি না শোনো, তোমার সর্বনাশ করব! শোনো, আমি চাই আমারই মতন কুৎসিত দেখতে একটি স্ত্রী। তাহলে আমরা দুজনেই সুখের জীবন যাপন করতে পারব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, স্ত্রীকে নিয়ে মানুষের বসতি ছেড়ে চলে যাব পৃথিবীর কোনও সুদূর নির্জন প্রান্তে। মানুষের চোখ আর আমাদের দেখতে পাবে না।
যদি ফের ফিরে আসো?