যখন ভাষা শিখলুম, তখন নিজে আড়ালে থেকে অনেক ছোেটা ছোটো ব্যাপারে আমি তাদের উপকারে লাগবার চেষ্টা করতুম।
মাধব রোজ সকালে উঠে তাদের বাড়ির পিছনকার বন থেকে নিজে কাঠ কেটে আনত। সেই কাঠ জ্বালিয়ে তাদের রান্না হত।
একদিন করলুম কী, রাত-আঁধারে বনে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে মস্ত একবোঝা কাঠ এনে তাদের সদর দরজার সামনে ফেলে রেখে এলুম।
পরের দিন দরজা খুলে এই কাঠের বোঝা দেখে মাধব ও মাধবী বিস্ময়ে অবাক! তারপর এমনি ব্যাপার যখন নিত্যই হতে লাগল, তখন তারা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল। এই কথা শুনে দাদুও কম অবাক হলেন না। তাদের এই বিস্ময়ের ভাবটি আমি উপভোগ করতুম। শেষটা রহস্য বোঝবার চেষ্টা তারা ছেড়ে দিল।
মাঝে মাঝে ফলমূল শাক-শবজি পেলেও এনে দিতুম। দাদু বলতেন, আমরা গরিব বলে আমাদের ওপরে বোধহয় বনদেবতার দয়া হয়েছে।
মাধব বলত, এসব ভূতুড়ে কাণ্ড। মাধবী বলত, যে-ভূত এত উপকার করে তাকে দেখলেও আমি ভয় কর না?
শুনে আমার মনে আশা জাগত। ভাবতুম, একদিন হয়তো ওদের সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব হবে! এ কথা ভাবলেও বন্ধুহীন আমার মনে জেগে উঠত পরম সান্ত্বনার ভাব।
একদিন সন্ধ্যার সময় ওদের বাড়িতে এল একটা মহা কুৎসিত লোক। যেমন কালো, তেমনি মোটা, তেমনি বেঁটে। স্নান দীপের আলোতে তার মুখের কদর্যতা আমার নজর এড়াল না।
কথাবার্তা শুনে বুঝলুম, দাদু কবে এর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন, ও তাই। আদায় করতে এসেছে।
দাদু কাতর স্বরে বললেন, মশাই, আর কিছুদিন সবুর করুন। আপাতত আমার অবস্থা তো দেখছেন, এখন টাকা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আর কিছুদিন যাক, মাধবের মাইনে বাড়ুক, তারপর মাসে মাসে আপনার টাকা শোধ করব।
লোকটা গর্জন করে বলে উঠল, না, না—আমি আর সবুর করব না। তোমাকে এক মাস সময় দিলুম, এর মধ্যে যদি টাকা না পাই, এ বাড়ি থেকে তোমাকে তাড়িয়ে তবে ছাড়ব?
সর্বনাশ, দাদু আর মাধব মাধবীকে যদি এখান থেকে বিদায় করে দেয়, তাহলে আমার হাল কী হবে? দুঃখের সাগরে এইটুকু আমার সুখের দ্বীপ, শেষটা কি এর থেকেও বঞ্চিত হব?
দারুণ ক্রোধে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। তখন রাত্রিকাল, আকাশে ফুটেছে চাঁদের আলো।
পাওনাদার যখন রাস্তায়, আমি এক দৌড়ে রুদ্র মূর্তিতে তার সুমুখে গিয়ে হাজির। আমাকে দেখেই তার চক্ষুস্থির, দারুণ আতঙ্কে সে কেবল ঠক ঠক করে কাপতে লাগল— একবার চাচাতেও পারলে না।
আমি ক্যাঁক করে তার গলা চেপে ধরে তাকে বিড়াল বাচ্চার মতন শূন্যে তুলে দু-একটা ঝকানি মেরে মাটির ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললুম, আমি হচ্ছি দাদু আর মাধব-মাধবীর বন্ধু! দাদুকে এ বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলে তোকে খুন করে ফেলব। এই বলেই অদৃশ্য হলুম।
পরের দিনেই এই ঘটনার কথা বোধহয় ও-বাড়ির সকলের কানে উঠল। কারণ আমি শুনলুম, দাদু উত্তেজিত ভাবে বলছেন, বনদেবতা, বনদেবতা! আমাদের ওপরে বনদেবতার দয়া হয়েছে!
মাধব বলল, আশ্চর্য ভূত।
মাধবী বলল, এমন ভালো ভূতকে আমি প্রণাম করি।
আমার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
ইতিমধ্যে হঠাৎ আর একটা ভীষণ আবিষ্কার করলুম।
একদিন একটি নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি, জলের ভেতরে ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি সেই রাক্ষুসে মূর্তিটা দেখেই প্রথমটা ভয়ে আমি চমকে উঠলুম। কিন্তু তারপরেই বুঝতে পারলুম, জলে পড়েছে আমারই ছায়া। আমার চেহারা এমন ভয়াবহ। সমস্ত প্রাণমন হা হা করে উঠল। কিন্তু তখনও আমি ভালো করে বুঝতে পারিনি, এই চেহারার জন্যে আমার অদৃষ্টে আরও কত দুর্ভোগ লেখা আছে!
একটি সুন্দর সন্ধ্যা। আকাশে পূর্ণিমার চাদ। বসন্ত-বাতাসে ফুলের আতর।
মাধবীকে নিয়ে মাধব বেড়াতে বেরিয়েছে। দাদু জানলার ধারে একলা বসে বেহালার তারে করছেন অপূর্ব সুরসৃষ্টিতার মুখের ওপরে এসে পড়েছে চাঁদের আলো।
সুর শুনতে শুনতে আমার বুকটাও যেন ভরে উঠল বাসন্তী জ্যোৎস্নায়। প্রাণের আবেগে নিজের ভয়াবহ কদর্যতার কথাও ভুলে গেলুম।
মনে হল, এই হচ্ছে দাদুর সঙ্গে ভাব করবার উপযুক্ত সময়। দাদু একলা, তিনি চোখেও দেখতে পান না। তার সঙ্গে আলাপ করে আসি!
আমি একেবারে ও বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দাদুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
আমার ভারী পায়ের শব্দ দাদুর কানে গেল। বাজনা থামিয়ে তিনি বললেন, কে? ভয়ে ভয়ে বললুম, আমি বিদেশি। আপনার কাছে একটু বসতে পারি কি?
মধুর হাসিমাখা মুখে দাদু স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়! ভেতরে আসুন। ওই চেয়ারে বসুন।
আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে চেয়ারে না বসে দাদুর কাছেই বসে পড়লুম। কি: ক বলে কথা আরম্ভ করব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলুম।
দাদু বললেন, আপনি বিদেশি হলেও আপনার কথা শুনে বুঝছি, আপনি বাঙালি।
আমি বললুম, আমি বাঙালি নই, তবে বাংলা বলতে শিখেছি বটে।
কার কাছে শিখেছেন? বাঙালিরই কাছে। কিন্তু ওসব কথা এখন থাক—আমার অন্য কথা আছে।
বলুন।
দেখুন, আমি কেবল বিদেশি নই—আমি বড়ো হতভাগ্য লোক। আমি সমাজচ্যুত–জাতিচ্যুত। কেউ আমাকে দু-চোখে দেখতে পারে না।
বিদেশি, আপনার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে দুঃখিত হলুম।
আমি একটি বাঙালি পরিবারকে ভালোবাসি—যদিও সে পরিবারের কেউ আমাকে চেনে না। আমি তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চাই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, তাদের কাছে গেলে যদি তারাও আমাকে ত্যাগ করে। তাদের হারালে আমি পৃথিবীর সব হারাব!