পথিক । দেখুন মশাই! কি করে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ত ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে বলছি‒ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা ত কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখি। একটা লোক তেষ্টায় জল-জল করছে তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?
মামা । শুনেছি বৈকি‒ চোখে দেখেছি। বদ্যিনাথকে কুকুরে কামড়াল, বদ্যিনাথের হল হাইড্রোফোবিয়া‒ যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না‒ যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিঁচ ধরে যায়। মহা মুশকিল!‒ শেষটায় ওঝা ডেকে, ধুতুরো দিয়ে ওষুধ মেখে খওয়ালো, মন্তর চালিয়ে বিষ ঝাড়ল‒ তারপর সে জল খেয়ে বাঁচল। ওরকম হয়।
পথিক । নাঃ‒ এদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা গেল না‒ কেনই বা মরতে এসেছিলাম এখেনে? বলি, মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো খাঁটি জল কিছু নেই?
মামা । আছে বৈকি! এই দেখুন না বোতলভরা টাটকা খাঁটি ‘ডিস্টিল ওয়াটার’‒ যাকে বলে ‘পরিশ্রুত জল’।
পথিক । (ব্যস্ত হইয়া) এ জল কি খায়?
মামা । না, ও জল খায় না‒ ওতে স্বাদ নেই‒ একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল‒ এখনো গরম রয়েছে।
পথিকের হতাশ ভাব
তারপর যা বলছিলাম শুনুন‒ এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল‒ এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপী জল ঢেলে দিলুম‒ বাস, গোলাপী রঙ উড়ে শাদা হয়ে গেল। দেখলেন ত?
পথিক । না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি‒ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি‒ কিচ্ছু মানি না‒ কিচ্ছু বিশ্বাস করি না।
মামা । কি বললেন! আমার কথা বিশ্বাস করেন না?
পথিক । না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না, কিচ্ছু বিশ্বাস করব না।
মামা । বটে! কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি‒ আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি‒
পথিক । তাহলে দেখান দেখি। শাদা, খাঁটি চমৎকার, ঠাণ্ডা, এক গেলাশ খাবার জল নিয়ে দেখান দেখি। যাতে গন্ধপোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লাটয়লা কিচ্ছু নেই, তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি। খুব বড় এক গেলাশ ভর্তি জল নিয়ে আসুন ত।
মামা । এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি‒ ওরে ট্যাঁপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাশ জল নিয়ে আয় ত।
পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড়
নিয়ে আসুক তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি। ঐ জলে কি রকম হয়, আর এই নোংরা জলে কি রকম তফাৎ হয়, সব আমি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি।
জল লইয়া ট্যাঁপার প্রবেশ
রাখ এইখানে রাখ।
জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ‒ মামার হাত হইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ করা
পথিক । আঃ! বাঁচা গেল!
মামা । (চটিয়া) এটা কি রকম হল মশাই?
পথিক । পরীক্ষা হল‒ এক্সপেরিমেন্ট! এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান ত, কি রকম হয়?
মামা । (ভীষণ রাগিয়া) কি বললেন!
পথিক । আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন‒ পরে খবেন এখন। আর এই গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সব কটাকে খানিকটা করে খাইয়ে দেবেন। তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমার খবর দেবেন‒ আমি খুশী হয়ে ছুটে আসব‒ হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার!
পথিকের দ্রুত প্রস্থান
পাশের গলিতে কে সুর করিয়া হাঁকিতে লাগিল‒ অবাক জলপান
ভাবুক সভা
পাত্রগণ : ভাবুক দাদা । প্রথম ভাবুক । দ্বিতীয় ভাবুক । ভাবুক দল ।
ভাবুকদাদা নিদ্রাবিষ্ট – ছোকরা ভাবুকদলের প্রবেশ
প্রথম ভাবুক । অবাক কল্লে! ঠিক যেমন শাস্ত্রে আছে উক্ত— ভাবের ঝোঁকে একেবারে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। সাংঘাতিক এ ভাবের খেলা বুঝতে নারে মূর্খ— ভাবরাজ্যের তত্ত্ব রে ভাই সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম!
দ্বিতীয় ভাবুক । ভাবটা যখন গাঢ় হয়- বলে গেছেন ভক্ত, হৃদয়টাকে এঁটে ধরে আঠার মতো শক্ত।
প্রথম ভাবুক । (যখন) ভাবের বেগে জোয়ার লেগে বন্যা আসে তেড়ে, আত্মারূপী সূক্ষ্ম শরীর পালায় দেহ ছেড়ে— (কিন্তু হেথায় যেমন গতিক দেখছি শঙ্কা হচ্ছে খুবই আত্মা পুরুষ গেছেন হয়তো ভাবের স্রোতে ডুবি। যেমন ধারা পড়ছে দেখ গুরু-গুরু নিঃশ্বাস, বেশিক্ষণ বাঁচবে এমন কোরো নাকো বিশ্বাস। কোনখানে হায় ছিঁড়ে গেছে সূক্ষ্ম কোনো স্নায়ু ক্ষণজন্মা পুরুষ কিনা, তাইতে অল্প আয়ু।
ভাবের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে ভবের পারে যায় রে
ভাবুক ভবের পারে যায়।
ভবের হাটে ভাবের খেলা, ভাবুক কেন ভোল?
ভাবের জমি চাষ দিয়ে ভাই ভবের পটোল তোল রে
ভাই ভবের পটোল তোল।
শান বাঁধানো মনের ভিটেয় ভাবের ঘুঘু চরে—
ভাবের মাথায় টোক্কা দিলে বাক্য-মানিক ঝরে রে মন
বাক্য-মাণিক ঝরে।
ভাবের ভারে হদ্দ কাবু ভাবুক বলে তায়
ভাব-তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ভাবের খাবি খায় রেভাবুক ভাবের খাবি খায়।