বৃদ্ধের সশব্দে জানলা বন্ধ করণ
পথিক । নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না।
লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ
লোকটা নেহাৎ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি। মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ছোকরা । কি বলছেন? ‘জল’ মিলবে না? খুব মিলবে। একশোবার মিলবে! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒ জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্ চল্ , আঁখিজল ছল্ছল্ , নদীজল কল্কল্ , হাসি শুনি খল্খল্ অ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল‒ কত চান?
পথিক । এ দেখি আরেক পাগল! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি।
ছোকরা । তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন‒ যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব।
পথিক । ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) মশাই! আর কিছু চাইনে, ‒(আরো জোরে) শুধু একটু জল খেতে চাই!
ছোকরা । ও বুঝেছি। শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই। এই ত? আচ্ছা বেশ। এ আর মিলবে না কেন?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই ‒ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাই। চাই কিন্তু কোথা গেলে পাই‒বল্ শীঘ্র বল্ নারে ভাই। কেমন? ঠিক মিলেছে তো?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার। (সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে‒ একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা করে নি। [একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল]
ছোকরা । (খুশী হইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না? বলি, মেলাচ্ছে কে? সেবার যখন বিষ্টুদাদা ‘বৈকাল’ কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন ‘নৈপাল’ বলে দিয়েছিল কে? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত? নেপালের লোক হল নৈপাল। (পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায়? দুত্তোরি!
ছোকরার প্রস্থান
নেপথ্যে বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ‒ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ!
পথিক । ওহে খোকা! একটু এদিকে শুনে যাও তো?
রুক্ষমুর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হইতে বাহির হইলেন
মামা । কে হে? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ?‒ (পথিককে দেখিয়া) ও! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোন ছোকরা বুঝি। আপনার কি দরকার?
পথিক । আজ্ঞে , জল তেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি‒ তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না।
মামার তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া
মামা । কেউ বলতে পারলে না? আসুন, আসুন। কি খবর চান, কি জানতে চান, বলুন দেখি? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি।
পথিককে মামার ঘরের মধ্যে টানিয়া নেওয়া
দ্বিতীয় দৃশ্যঘরের ভিতর
ঘর নানারকম যন্ত্র, নকশা, রাশি রাশি বই ইত্যাদিতে সজ্জিত
মামা । কি বলছিলেন? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি‒
মামা । আ হা হা! কি উৎসাহ! শুনেও সুখ হয়। এ রকম জানবার আকাঙ্খা কজনের আছে, বলুন ত? বসুন! বসুন! (কতকগুলি ছবি, বই আর এক টুকরা খড়ি বাহির করিয়া ) জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কি গুণ‒
পথিক । আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি‒
মামা । আসছে‒ ব্যস্ত হবেন না। একে একে সব কথা আসবে। জল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন‒
মামা বোর্ডে খড়ি দিয়া লিখিলেন H2 + O = H2O
পথিক । এই মাটি করেছে!
মামা । বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়‒ হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। আর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই হল জল! শুনছেন তো?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, সব শুনছি। কিন্তু একটু খাবার জল যদি দেন, তাহলে আরো মন দিয়ে শুনতে পারি।
মামা । বেশ ত! খাবার জলের কথাই নেওয়া যাক না। খাবার জল কাকে বলে? না, যে জল পরিস্কার, স্বাস্থকর, যাতে দুর্গন্ধ নাই, রোগের বীজ নাই‒ কেমন? এই দেখুন এক শিশি জল‒ আহা, ব্যস্ত হবেন না। দেখতে মনে হয় বেশ পরিস্কার, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছে। কেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা‒ এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড়। এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্গিজ্ করছে‒ প্লেগ, টইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ‒ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন! এই ছবি দেখুন‒ এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ‒সব আছে। আর এই সব হচ্ছে জলের পোকা‒ জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায়। আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন! পচা পুকুরের জল‒ ছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ।
পথিক । উঁ হুঁ হুঁ হুঁ! করেন কি মশাই? ওসব জানবার কিচ্ছু দরকার নেই‒
মামা । খুব দরকার আছে। এসব জানতে হয়‒ অত্যন্ত দরকারী কথা!
পথিক । হোক দরকারী‒ আমি জানতে চাইনে, এখন আমার সময় নেই‒
মামা । এই ত জানবার সময়। আর দুদিন বাদে যখন বুড়ো হয়ে মরতে বসবেন, তখন জেনে লাভ কি? জলে কি কি দোষ থাকে, কি করে সে সব ধরতে হয়, কি করে তার শোধন হয়, এসব জানবার মতো কথা নয়? এই যে সব নদীর জল সমুদ্রে যাচ্ছে, সমুদ্রের জল সব বাস্প হয়ে উঠছে, মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে‒ এরকম কেন হয়, কিসে হয়, তাও ত জানা দরকার?