তিনি ঘরের মধ্যেই ছিলেন।
অনেক রাত পর্যন্ত কিরীটীর মাথায় ঐ চিন্তাগুলোই ঘোরাফেরা করতে থাকে বারংবার। কে ঐ মহিলা!
আর কেই বা সেই আগন্তুক নিশীথ রাত্রে গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছিলেন কবিরাজ-ভবনে!
কিরীটী এই কয়দিনে পাড়ার দুচারজনের কাছ থেকে ও অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপ নিয়ে বসে বসে কবিরাজ মশাইয়ের সম্পর্কে যে সংবাদটকু আজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে তাতে করে এইটাই বোঝা যায় যে ভিষগরত্ন লোকটি মন্দ নয়। নির্বিবাদী, শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক; পাড়ায় কারো সঙ্গে কোন ঝগড়া-বিবাদ নেই। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। নিজের কবিরাজী ব্যবসা ও ঔষধপত্র নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত।
মিতভাষী কবিরাজ মশাই পাড়ার কারো সঙ্গেই বড় একটা মেশামেশি করেন না। যদিও তাঁর পুত্রকন্যার সঙ্গে অনেকেরই আলাপ-পরিচয় আছে পাড়ার মধ্যে।
কবিরাজ মশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে নতুন করে আবার কিরীটীর অনিলবাবুর কথা মনে পড়ে।
কিরীটীর ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন।
ঐ মধ্যরাত্রির শান্ত নিস্তব্ধতায় একাকী ঐ ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি যেন কিরীটীর মনকে অক্টোপাশের ক্লেদাক্ত অষ্টবাহুর মত চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরতে থাকে।
মাত্র মাস দেড়েক আগে হঠাৎ একদিন প্রত্যুষে তাঁকে এ ঘরে আর দেখা গেল না এবং পরে তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পিছনের রাস্তায়। ভদ্রলোকের প্রেম ছিল একটি তরুণীর সঙ্গে।
বাগনান গার্লস স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্ৰী। নাম বিনতা দেবী।
আচ্ছা, ভদ্রমহিলা অনিলবাবুর আজ পর্যন্ত কোন খোঁজখবর নিলেন না কেন?
হঠাৎ মনে হয় কিরীটীর, বাগনানে গিয়ে বিনতা দেবীর সঙ্গে একটিবার দেখা করলে কেমন হয়!
কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ঠিক করে ফেলে, কাল সকালে উঠেই সোজা সে একবার বাগনানে যাবে সর্বপ্রথম।
দেখা করবে সে বিনতা দেবীর সঙ্গে একবার।
সত্যি সত্যি পরের দিন সকালে উঠে কিরীটী সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে গোমো প্যাসেঞ্জারে উঠে বসল বাগনানের একটা টিকিট কেটে। বেলা সাড়ে নয়ট নাগাদ কিরীটী বাগনান স্টেশনে এসে নামল।
গালর্স স্কুলটির নাম বিদ্যার্থী মণ্ডল। এবং স্কুলটা স্টেশন থেকে মাইলখানেক দুরে ছোট্ট শহরের মধ্যেই।
ভাঙাচোরা কাঁচা মিউনিসিপ্যালিটির সড়কটি বোধ হয় শহরের প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।
লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে বেলা এগারটা নাগাদ কিরীটী স্কুলে গিয়ে পৌছাল।
এম. ই. স্কুল।
ছোট একতলা একটা বাড়ি। শতখানেক ছাত্রী হবে।
স্কুল তখন বসেছে। অফিস-ঘরে গিয়ে ঢুকল কিরীটী।
চোখে পুরু কাঁচের চশমা সুতা দিয়ে মাথার সঙ্গে পেচিয়ে বাঁধা, মাথায় টাক এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা ভাঙা চেয়ারের উপর বসে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে একটা মোটা বাঁধানো খাতায় কি যেন একমনে লিখছিলেন। সামনে আরো খান-দুই ভাঙা চেয়ার ও একটা নড়বড়ে ভাঙা বেঞ্চ।
ও মশাই শুনছেন! কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ডাকে।
ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন পর লেন্সের ওধার থেকে।
ভদ্রলোক একটু বেশ কানে খাটো, কিরীটীর গলার শব্দটাই কেবল বোধ হয় গোচরীভূত হয়েছিল, বললেন, বগলাবাবু চলে গেছেন।
বগলাবাবু! বগলাবাবু, আবার কে?
কী বললেন, কাকে?
বলছি শুনছেন, কিরীটী এবারে কানের কাছে এসে একটু গলা উচিয়েই বলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্মিতহাস্যে।
ভদ্রলোকও বোধ হয় এবারে শুনতে পান।
বললেন, কি বলছেন?
বিনতা দেবী বলে কোন শিক্ষয়িত্ৰী আপনাদের স্কুলে আছেন?
আছেন। কি প্রয়োজন?
প্রয়োজন আমার তাঁরই সঙ্গে।
তাহলে বসুন, এখন তিনি ক্লাসে। টিফিনে দেখা হবে।
টিফিন কখন হবে?
ঠিক একটায়। বলেই ভদ্রলোক আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করলেন।
অগত্যা কী আর করা যায়, কিরীটীকে বসতেই হল। একটা চেয়ার টেনে কিরীটী তার উপরে বসে আসিবার সময় স্টেশন থেকে কেনা ঐদিনকার সংবাদপত্রটা খুলে চোখ বুলাতে লাগল। সবে বেলা এগারটা। এখনো টিফিন হতে দুঘণ্টা দেরি!
খবরের কাগজটা খুলে বসলেও তার মধ্যে কিরীটী মন বসাতে পারছিল না।
বিনতা দেবীর কথাই সে ভাবছিল। হঠাৎ তো মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এখানে চলে এলো!
ভদ্রমহিলা কোন টাইপের তাই বা কে জানে! তাকে কি ভাবে তিনি নেবেন তাও জানা নেই।
ভাল করে তিনি যদি কথাই না বলেন, কোন কথা না শুনেই যদি তাকে বিদায় দেন।
কিন্তু কিরীটী অত সহজে হাল ছাড়বে না। যেমন করে তোক তাঁর কাছ থেকে সব শুনে যেতেই হবে।
কিরীটী বসে বসে ভাবতে থাকে কি ভাবে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করবে।
কিন্তু বেলা একটা পর্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে কিরীটীকে অপেক্ষা করতে হল না
মিনিট কুড়ির মধ্যেই একটি নারীকণ্ঠে আকৃষ্ট হয়ে কিরীটী মুখ তুলে তাকাতেই তেইশ-চব্বিশ বৎসর বয়স্কা এক তরুণীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।
পাতলা দোহারা চেহারা। গায়ের বর্ণ উজ্জল শ্যাম। চোখ মুখ চিবুক বেশ ধারালো। মাথায় পর্যাপ্ত কেশ এলো খোঁপা করা। দুহাতে একগাছি করে সরু তারের সোনার বালা। পরিধানে সরু কালাপাড় একখানি তাঁতের শাড়ি।
কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তরুণী দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে অদূরে লিখনরত উপবিষ্ট বন্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, অবিনাশবাবু, আমার মাইনেটা কি আজ পাবো?
অবিনাশবাবু, বোধ হয় শুনতে পাননি, বললেন, জমানো—জমানো টাকা আবার কোথা থেকে এলো আপনার?