অন্যমনস্ক ভাবে শ্লথ পায়ে কিরীটী ফিরছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিরীটী। গলিপথের শেষ প্রান্তের প্রায় সমস্তটাই জড়ে একটা কালো রঙের সিডন বডি গাড়ির পশ্চাৎ দিকের অংশটা যেন সামনের শেষ পথটুকুর সবটাই প্রায় রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আবছা আলো-আঁধারিতে গাড়ির পেছনের প্রজলিত লাল আলোটা যেন শয়তানের রক্তচক্ষুর মত ধকধক করে জ্বলছে।
এবং পথের মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কিরীটীর অন্যমনস্ক নিষ্ক্রিয়তাটা কেটে যায়।
সমস্ত ইন্দ্রিয় তার সজাগ ও সক্রিয় হয়ে ওঠে মুহূর্তে।
এই পরিচিত অপ্রশস্ত গলির মধ্যে এত রাত্রে অত বড় চকচকে গাড়িতে চেপে কার আবার আবির্ভাব ঘটলো!
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মনে পড়ে, ইতিপূর্বে আরো দুদিন এই গলিপথেই কোন গাড়ি ঠিক আসতে বা যেতে তার নজরে না পড়লেও গাড়ির টায়ারের কাদা-মাখা ছাপ তার চোখে পড়েছে।
তবে হয়ত এই গাড়িরই টায়ারের ছাপ ও দেখেছে! গাড়ির পিছনের নাম্বার প্লেটটার দিকে ও তাকাল।
W. B. B. 6690।
আবছা আলো-অন্ধকারেও গাড়ির কালো মসৃণ বডিটা চকচক করছে।
হঠাৎ কিরীটী আবার সর্তক হয়ে ওঠে গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দে।
তারপরই কানে এলো দুটি কথা। আচ্ছা, তাহলে ঐ কথাই রইল। একটি চাপা পুরুষ-কণ্ঠ। দ্বিতীয় কণ্ঠটি কোন নারীর হলেও কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায়। গাড়িটা ব্যাক করছে।
দ্রুতপদে কিরীটী পিছিয়ে গিয়ে ঐ গলির মধ্যেই বাড়ির মধ্যবতী সরু অন্ধকার প্যাসেজটার মধ্যে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।
গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করে গলিপথ থেকে বের হয়ে গেল। দামী গাড়ি, ইঞ্জিনের বিশেষ কোন শব্দই শোনা গেল না।
আরো চার-পাঁচ মিনিট বাদে কিরীটী আবার অগ্রসর হল বাসার দিকে অন্যমনস্কভাবে ভাবতে ভাবতে।
এবং একটু এগিয়ে যেতেই তার নজরে পড়লো নীচের তলায় কবিরাজ মশাইয়ের বাইরের ঘরের খোলা জানালাপথে তখনও আসছে আলোর একটা আভাস।
সদর দরজাটা বন্ধ কিন্তু গলির দিককার জানালা খোলা।
হঠাৎ কৌতুহলকে দমন করতে না পেরে কিছুমাত্র দ্বিধা না করে সতক পদসঞ্চারে শিকারী বিড়ালের মত পা টিপে টিপে আলোকিত বাইরের ঘরের জানালাটার সামনে এগিয়ে গেল কিরীটী।
জানালার নীচের পাট বন্ধ, উপরের পাটটা খোলা।
রাস্তা থেকে জানালা এমন কিছু উঁচু নয়, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালেই ভিতরের সব কিছু সহজেই নজরে পড়ে।
জানালার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে ত্যারচাভাবে কিরীটী আলোকিত কক্ষমধ্যে দৃষ্টিপাত করল। রোমশ ভল্লকের মত উদলো গায়ে জোড়াসন হয়ে কবিরাজ ভিষগরত্ন ফরাসের উপরে বসে আছেন।
আর তাঁর অদূরে ঘরের মধ্যেকার পার্টিশনের পর্দাটা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চিত্রাপিতের মত অপরূপ লাবণ্যময়ী এক নারী। বয়স কিছুতেই ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হবে না বলেই মনে হয়।
পরিধানে ধবধবে সাদা কালো চওড়া শান্তিপুরী শাড়ি। মাথার অবগুণ্ঠন খসে কাঁধের উপরে এসে পড়েছে।
গলার চকচকে সোনার হারের কিয়দংশ দেখা যায়। হাতে সোনার চুড়ি। কপালে দুই টানা বঙ্কিম সুর ঠিক মধ্যস্থলে একটি সিন্দূরের টিপ, কিন্তু ঐ সামান্য বেশভূষাতেও তার রূপ যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে।
কোন মানুষ নয়, যেন পটে আঁকা নিখুত একখানি চিত্র। মুগ্ধ কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টি যেন বোবা স্থির হয়ে থাকে।
হঠাৎ চাপাকণ্ঠে সেই নারীচিত্র যেন কথা বলে উঠলো, যথেষ্ট তো হয়েছে, আর কেন! এবারে ক্ষমা দাও।
নিঃশব্দ কুৎসিত হাসিতে ভল্লুকসদৃশ ভিষগরত্নের মুখখানা যেন আরো বীভৎস হয়ে উঠলো মুহর্তে। কেবল একটি কথা সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসির মধ্যে শোনা গেল, পাগল!
আচ্ছা তুমি কি! শয়তান না মানুষ!
আবার সেই কুৎসিত নিঃশব্দ হাসি ও সেই পুর্বোচ্চারিত একটিমাত্র শব্দ, পাগলী!
ছিঃ ছিঃ, গলায় দড়ি জোটে না তোমার!
দুঃসহ ঘৃণা ও লজ্জায় যেন ছিঃ ছিঃ শব্দ দুটি নারীকণ্ঠ হতে উচ্চারিত হল।
এবারে আর প্রত্যুত্তরে হাসি নয়। সেই পরিচিত দুটি কথা। মাগো! করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী সবই তোর ইচ্ছা মা
কবিরাজ মশাইয়ের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, যাও। যাও-ভিতরে যাও। পাগলামি করো না, আমার পূজার সময় হল।
এরপর আর ভদ্রমহিলা, দাঁড়ালেন না। কেবলমাত্র তীব্র তীক্ষ্ণ একটা কটাক্ষ হেনে মাথায় ঘোমটাটা তুলে দিয়ে নিঃশব্দে অন্দরেই বোধ হয় প্রস্থান করলেন। এবং যাবার সময় তাঁর দুচোখের দৃষ্টিটা যেন মুহূর্তের জন্য ধারালো ছুরির ফলার মত ঝিকিয়ে উঠলো বলে কিরীটীর মনে হলো।
ভিষগরত্ন মহিলাটির গমনপথের দিকে বারেকমাত্র তাকিয়ে আবার সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসি হাসলেন দন্তপাটি বিকশিত করে। এবং নিম্নকণ্ঠে বললেন, মাগো করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী!
ভদ্রমহিলাটি কে? ইতিপূর্বে কিরীটী ওঁকে কখনও দেখেনি।
তবে কি উনিই কবিরাজ মশাইয়ের সেই অন্তঃপুরচারিণী সদা-অবগুণ্ঠনবতী সহধর্মিণী! কিন্তু যদি তাই হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব একটা প্রীতির সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হল না কিরীটীর, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্ষণপূর্বের কথাগুলো শুনে!
আর অতবুড় চকচকে গাড়ি হাঁকিয়েই বা এই গভীর রাত্রে কে এসেছিল কবিরাজগৃহে!
দিনের বেলায় তো কখনো কাউকে অতবড় গাড়ি হাঁকিয়ে কবিরাজ-ভবনে কিরীটী আসতে দেখেনি আজ পর্যন্ত। এবং যেই হোক আগন্তুক, তাকে গাড়িতে বিদায় দিতে গিয়েছিল নিশ্চয়ই ঐ মহিলাই। কবিরাজ মশাই যাননি।