কে তোমার promise চায় হে ছোকরা! দ্বিজপদ, আমার লাঠিটা দাও তো–কবিরাজ মশাই হাঁক দিলেন।
পূজ্যপাদ ভাবী শ্বশুরের লাঠি! ভাবী পত্নীর পুজনীয় পিতৃদেব হলেও এযুগের আধুনিক হবু জামাইয়ের বোধ হয় আর সাহসে কুলায় না। সবেগে প্রস্থান করলেন। বেচারী রজতবাবু!
এমনিতে বাইরে শৌখিন প্রকৃতির ও নিরীহ শান্তশিষ্ট দেখতে হলে হবে কি, রজতবাবু, ভদ্রলোকটিকে তো কিরীটীর মনে হচ্ছে এখন বেশ করিতকর্মাই।
ইতিমধ্যে একসময় কখন এক ফাঁকে দিব্বি সুন্দরী কবিরাজ-নন্দিনীর মনোরঞ্জন করে বসে আছেন এবং স্বয়ং পিতৃদেব হয়েও ভিষগরত্ন ব্যাপারুটির বিন্দুবিসর্গ টের পাননি।
কিরীটী সংবাদপত্রে আর মনোনিবেশ করতে পারে না।
এবং একটু পরেই রজতবাবুর পদশব্দ সিঁড়িতে আবার শোনা গেল।
কিরীটী বুঝতে পারে রজতবাবু, তাঁর ঘরে এসে প্রবেশ করলেন এবং আবার সঙ্গে সঙ্গে পদশব্দে বোঝা গেল বাইরে বের হয়ে গেলেন।
সেই যে রজতবাবু, গেলেন, দিন দুই আর ফিরলেন না মেসে।
কিন্তু আশ্চর্য, উক্ত ব্যাপার নিয়ে সেই দিন বা তার পরের দিনও নীচে ভিষগরত্নের অন্দরমহলে কোনপ্রকার সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না!
এমন কি পরের দিন দ্বিপ্রহরের দিকে কিরীটীকে একটু বের হতে হয়েছিল, ফিরবার পথে গলির মাথায় অমলার সঙ্গে চোখাচোখিও হয়ে গেল। সঙ্গে তার এক সহপাঠিনী বা বান্ধবী বোধ হয় ছিল। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে কবিরাজ-গৃহের দিকেই আসছিল।
রজতবাবু, ফিরে এলেন দিন দুই পরে দ্বিপ্রহরে।
জ্যৈষ্ঠের শেষ। প্রখর রৌদ্রুতপ্ত দ্বিপ্রহরে আকাশটা যেন একটা তামার টাটের মত পুড়ে ঝাঁঝাঁ করছে। বাতাসে যেন আগুনের উগ্র একটা বিশ্রী ঝাঁজ।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কিরীটী একটা টেবিলফ্যান চালিয়ে একজোড়া তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল বাইরে থেকে রজতবাবুর গলা শোনা গেল।
ভিতরে আসতে পারি কিরীটীবাবু! আরে কে ও, রজতবাবু যে! আসুন আসুন।
দরজা ঠেলে রজতবাবু এসে কিরীটীর ঘরে প্রবেশ করলেন।
বেশভূষা যেন সামান্য একটু মলিন, মাথার চুল অযত্ন-বিন্যস্ত, মুখখানি কিন্তু বেশ প্রফুল্লই মনে হল।
হঠাৎ রজতবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন কিরীটীর মনে হয়, মাত্র এই দুই দিনেই ভদ্রলোকের বয়সটা যেন হু হু করে বেড়ে গিয়ে গালে ও কপালে বয়সের রেখা পড়েছে।
বসুন বসুন—তারপর কি খবর রজতবাবু? এ দুদিন ছিলেন কোথায়?
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে রজতবাবু বললেন, একটু কাজে গিয়েছিলাম বর্ধমানে।
কিরীটী উঠে টেবিলফ্যানটা একটু ঘুরিয়ে দিল রজতবাবুর দিকে। বললে, ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে বোধ হয়?
না। দাদামশাইয়ের একটা বাড়ি আছে বর্ধমানে। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ঐখানেই তো ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বাড়িটা তালা দেওয়াই পড়েছিল। কথাগুলো বলে একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, কলকাতায় আর নয়। ভাবছি, এবার সেখানে গিয়েই থাকবো।
কাজকর্মের আপনার অসুবিধা হবে না কলকাতা ছেড়ে গেলে?
মশাই। কলকাতা শহর তো নয় যেন একটা বাজার। ঘেন্না ধরে গিয়েছে আপনাদের এই ধুলো বালি ধোঁয়া আর ছত্রিশ জাতের মানুষের ভিড়ের কলকাতা শহরের ওপরে। মানুষ থাকে এখানে!
কিরীটী আজকে রজতবাবুর কথাগুলো শুনে যেন বেশ একটু অবাক হয়। কারণ কয়েকদিন আগেও রজতবাবুকে কিরীটী বলতে শুনেছে, ছোঃ ছোঃ আপনাদের গ্রাম্যজীবন আর সুবার্ব মাথায় থাক আমার! বেঁচে থাক আমার এ কলকাতা শহর। কথাটা বলছিলেন রজতবাবু সিনেমার গেটকীপার জীবনবাবুকে। আজকাল মানুষের সেরা তীর্থস্থান হল কলকাতা আর বোম্বাই—এই দুটি শহর, বুঝলেন মশাই!
কিন্তু কিরীটী মুখে জবাব দেয়, তা যা বলেছেন।
হঠাৎ পরক্ষণেই রজতবাবু, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা চলি মশাই। দক্ষিণ পাড়ায় একটা জরুরী কাজ আছে, সেরে আসি।
রজতবাবু আর দাঁড়ালেন না। বের হয়ে গেলেন। হঠাৎ যেমন এসেছিলেন তেমনি হঠাৎই যেন প্রস্থান করলেন।
কেনই বা এলেন আবার হঠাৎ কেনই বা চলে গেলেন কিরীটী যেন ঠিক বুঝতে পারে না।
বর্ধমানে গিয়েছিলেন এই সংবাদটুকুই মাত্র কিরীটীকে দেবার এমনই বা কি প্রয়োজন ছিল! না, ভদ্রলোকের আরো কিছু বলবার বা কিছু জানাবার ছিল কিরীটীর কাছে। অন্যমনস্ক ভাবে কিরীটী তাসগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।
দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ নির্জনতায় একটা ক্লান্ত রিকশার ঘণ্টির ঠং ঠং শব্দ নীচে গলির পথে ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল।
বাইরে বারান্দায় রেলিংয়ের ওপরে বসে একটা কাক কর্কশ স্বরে কা কা করে ডাকছে।
৪. রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা
ঐদিনই রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।
নিত্যনৈমিত্তিক রাতের টহল সেরে কিরীটী ন্যায়রত্ন লেনের বাসায় ফিরছিল। নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পাড়াটা। গলির মুখে গ্যাসের বাতিটাও যেন স্তিমিত মধ্যরাত্রির ক্লান্ত রাতজাগা প্রহরীর মত একচক্ষু, মেলে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে একান্ত নির্লিপ্ত ভাবে।
গলিপথের শেষ পর্যন্ত শেষ গ্যাসের আলোটি পর্যাপ্ত নয়। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে একটা আলোছায়ায় যেন রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে গলিপথের শেষপ্রান্তে।
মধ্যগ্রীষ্ম রাতের আকাশের যে অংশটুকু মাথা তুলে উপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে সেখানে শুধু, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঝকঝকে তারা।