প্রায় সদা নিঃশব্দ লোকটির বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ হতে ঐ করালবদনী মৃমুণ্ডমালিনী শব্দ দুটি যেন সমস্ত নীচের তলাটা গম গম করে তুলত।
কবিরাজ ও তস্য গৃহিণীকে বাড়ির বাইরে না দেখা গেলেও দ্বিজপদ, ঝি সুন্দরী ও কবিরাজের ছেলে অনিলশেখর ও মেয়ে অমলাকে প্রায়ই আসতে যেতে দেখা যেত।
তাদের চেহারা চালচলন বেশভূষা কোনটারই যেন কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যেত না কবিরাজের সংস্কৃতির সঙ্গে।
পরিচ্ছন্ন ছিমছাম বেশভূষা উভয়েরই।
অনিলশেখর বি. এ. ক্লাসের চতুর্থ বার্ষিকীর ছাত্র এবং মেয়ে অমলা আই. এ. ক্লাসের ছাত্রী।
একদিন সন্ধ্যার দিকে নিত্যকারের মত সাধ্যভ্রমণে বের হয়ে গলির মুখে নিম্নকণ্ঠে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনারত অমলা ও রজতবাবুকে দেখে কিরীটী বুঝতে পেরেছিল রজতবাবুর নীচের তলায় সত্যকারের আকর্ষণটি কোনখানে।
কিন্তু ন্যায়রত্ন লেনের উপর ও নীচের তলার অধিবাসীদের লক্ষ্য করার চাইতেও যে উদ্দেশ্যে কিরীটী খুঁজে পেতে কষ্ট করে ঐ অঞ্চলে এসে ডেরা বেধেছিল, কিরীটীর চিন্তাধারাটা বেশির ভাগ সময় বিক্ষিপ্ত ভাবে তারই মধ্যে আবদ্ধ থাকত বলাই বাহুল্য।
দিন পনের গত হয়ে গেল কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোন কিছুই ঐ অঞ্চলের কিরীটীর অনুসন্ধিৎসু মনকে নাড়া দিতে পারেনি।
তবু তার সতর্কতার অভাব ছিল না। বাইরে থেকে বেকার শান্তশিষ্ট ও একান্ত নির্লিপ্ত তাকে মনে হলেও ভিতরে ভিতরে তার তীক্ষ্ণ শ্রবণ-মননশক্তি চারিদিকেই সমভাবে প্রক্ষিপ্ত হয়ে থাকত।
সকালে ও দ্বিপ্রহরে কিরীটী নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরই হত না। বের হত একেবারে সন্ধ্যা সাতটার পর। এবং রাত বারোটা, কখনো কখনো বা একটা দেড়টা পর্যন্ত আশেপাশে সমস্ত অঞ্চলটার পথে গলিতে সদাসতর্ক দৃষ্টিতে, অথচ বাইরে নির্লিপ্ত পথিকের মত ঘুরে ঘুরে বেড়াত।
এমনি করেই দিন চলছিল।
সহসা এমন সময় একদিন শান্তস্থির পুষ্করিণীর জলরাশিতে ছোট্ট একটি লোস্ট্রাঘাতে যেমন তরঙ্গ জাগে এবং ক্রমে সেই চক্রাকারে ক্রমবিস্তৃতমান তরঙ্গচক্র তটপ্রান্তে আছড়ে পড়ে শব্দ তোলে, ঠিক সেইভাবেই ব্যাপারটা শব্দায়িত হয়ে উঠলো আচমকা।
বিকেল চারটে হবে।
উপরের তলার সেমি-মেসের বোর্ডাররা কেউই তখন অফিস ও কর্মস্থল থেকে ফেরেন নি, একমাত্র রজতবাবু ব্যতীত। অবশ্য কিরীটী তার ঘরে নিত্যকারের মত দরজাটা ভেজিয়ে ঐদিনকার বহুবার পঠিত সংবাদপত্রটাই আবার উল্টে-পাল্টে দেখছিল।
রজতবাবু, দিন চারেক ছিলেন না মেসে। ঐদিন সকালের দিকে পাটনা থেকে ফিরেছেন টুর সেরে।
গুনগুন করে সর্বদাই প্রায় যতক্ষণ রজতবাবু তাঁর ঘরে থাকেন, গান করা তাঁর একটা অভ্যাস। এবং কিরীটী পাশের ঘর থেকে তাঁর সেই গুনগুনানি শুনেই বুঝতে পেরেছিল রজতবাবু, তাঁর ঘরেই আছেন। আর মাত্র মিনিট কুড়ি আগে যে রজতবাবু, নীচে নেমেছিলেন তাঁর জুতোর শব্দেই বুঝতে পেরেছিল কিরীটী।
হঠাৎ নীচের তলা থেকে, বলতে গেলে এখানে আসবার পর এই প্রথম কিরীটী ভিষগরত্নের নাতি-উচ্চ কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সত্যিই চমকে ওঠে।
ভদ্রলোক! জেন্টেলম্যান! ঢের ঢের দেখা আছে আমার। ফের এ-বাড়িমুখো হয়েছে কি ঠ্যাং ভেঙে খোঁড়া করে দেবো জন্মের মতো। বেরোও! বেরিয়ে যাও!
কৌতূহলে কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ ও উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।
কবিরাজের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় রজতবাবুর মেয়েলী ঢংয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আপনি বা অত চেচাচ্ছেন কেন বলুন তো মশাই! বিবাহ করবো তো আমি, আর বিবাহটা হবে অমলার সঙ্গে আপনি তো অবান্তর তৃতীয় পক্ষ।
বাঘের মতই যেন ভিষগরত্ন এবারে গর্জে উঠলেন, কি কি বললি বেটা! আমি তার জন্মদাতা বাপ, আমি তৃতীয় পক্ষ! আর তুই কোথাকার এক ভবঘুরে ইনসিওরেন্সের দালাল, তুই হলি প্রথম পক্ষ! বেরো। বেরো এখান থেকে
বেরিয়ে আমি নিশ্চয়ই যাবো। মনে রাখবেন কেবল স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই কথাটা বলতে এসেছিলাম, নচেৎ মেয়েও আপনার সাবালিকা এখন। এ বিয়ে আপনি চেষ্টা করলেও আটকাতে পারবেন না।
রজতবাবুর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ভিষগরত্নের কণ্ঠ আবার শোনা গেল, কালই তুই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। নইলে তোর মত কুকুরদের কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি জানি। বেটা নচ্ছার পাজী ছুঁচো
থামুন থামুন-অত চেচাবেন না, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবো মশাই!
ওঃ, অথ বিবাহঘটিত! প্রেম-প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ব্যাপার!
সেই চিরপুরাতন অথচ চিরনতুন পঞ্চশরের ফুলবাণ পর্ব!
হায় হায় সন্ন্যাসী! কি করছো তুমি পঞ্চশরের ভস্মরাশি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে জানতে যদি! কিন্তু এ যে বেশ গুরুতর ব্যাপার!
প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে, বিবাহটা শেষ পর্যন্ত যদি ঘটে যায়ই, ভদ্রলোক শৌখিন রজতবাবুর পক্ষে তাঁর রোমশ ভল্লুকাকৃতি কবিরাজ শ্বশুরমশাইটির তো একেবারে বদহজম ঘটাবে!
নাঃ, আজকালকার আধুনিক মতিগতির ছেলেমেয়েরা বড় বেশী যেন দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে।
আবার রজতবাবুর কণ্ঠস্বর কিরীটীর কানে এলো, শুনুন মশাই, ভালর জন্যই বলছি, বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না এ নিয়ে। অমলাকে আমি বিবাহ করবোই, আপনার পিতৃত্বের পেনাল-কোডের আইন-কানুন ধোপে টিকবে না। মিথ্যে মিথ্যে কেন ঝামেলা করছেন! ভালয় ভালয় রাজী হয়ে যান। ভদ্রভাবে ব্যাপারটা চুকেচুকে যাক, all expense আমার I promise!