ছেলেটির বয়স তেইশ-চব্বিশের মধ্যেই। দ্বিজপদই কবিরাজ মশাইয়ের কম্পাউণ্ডার বা অ্যাসিস্টেন্ট। নীচের তলার তিনখানি ঘরের মধ্যে বাইরের প্রশস্ত ঘরটিতেই কবিরাজ মশাইয়ের রোগী দেখা হতে শুরু করে ডিসপেনসারীর, ঔষধের কারখানা এবং দ্বিজপদর থাকা-শোয়ার সব কিছু ব্যবস্থা।
ঘরের ২/৩ ও ১/৩ অংশের মধ্যে একটি কাঠের ফ্রেমে চটের পার্টিশন বসানো।
পার্টিশনের একদিকে খানচারেক পুরানো সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরি ভারী বার্নিশ ওঠা আলমারি। তার মধ্যে তাকের উপরে সাজানো ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের শিশি, বোতল, বয়ম, জার—নানাবিধ কবিরাজী তৈল, ভস্ম, গুলি, বটিচর্ণ প্রভৃতি ঔষধে ভর্তি।
সামনাসামনি বড় বড় দুটি তক্তপোশ, পাশাপাশি জোড়া দিয়ে উপরে একটি তৈল-চিটচিটে মলিন ফরাস বিছানো এবং তদুপরি অনুরুপ চারটি তাকিয়া।
শশিশেখর ভিষগরত্ন ঐ চৌকির ওপরে উপবিষ্ট অবস্থাতেই রোগীদের দেখা ও তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালান। একপাশে একটি বেঞ্চ পেতে রঙিন পুরাতন একটি শাড়ি দড়ির সাহায্যে টাঙিয়ে আড়াল তুলে
স্ত্রীরোগীদের দেখবারও ব্যবস্থা আছে।
বাড়িটার উপরের তলাটা ভাড়া দিয়ে, কবিরাজী ব্যবসা করে, নিজস্ব তৈরি পেটেন্ট দ্রাক্ষারিষ্ট, মহাবলচূর্ণ, অক্ষয় অমৃত সঞ্জীবনী সুধা, পারিজাত মোদক, মুক্তাভস্ম, মহাশান্তি বৃহৎ বনরাজী তৈল, ব্যাঘ্রাবল রসবটিকা, নয়নরঞ্জন সুর্মা ইত্যাদি সব বিক্রয় করে কবিরাজ মশায়ের যে বেশ দুপয়সা উপার্জন হয় সেটা তাঁর সচ্ছল অবস্থা দেখলেই অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না। প্রতি মাসে ২রা তারিখে একটিবার করে সকালে কবিরাজ মশাইয়ের কাষ্ঠপাদুকার খটখট শব্দ উপরে ওঠবার সিঁড়ির মুখে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
বোর্ডারদের সামনে এসে একের পর এক দাঁড়ান দন্ত ও মাড়িযোগে নিঃশব্দ কুৎসিত তাঁর সেই পেটেন্ট হাসিটি নিয়ে।
দেহরোম ও মেদবাহুল্যের জন্যই বোধ হয় কবিরাজ মশাইয়ের গ্রীষ্মবোধটা একটু বেশিই। শীত গ্রীষ্মে কোন প্রভেদ নেই। কবিরাজ মশাই তন্ত্রমতে কালীসাধক।
কপালের রক্তসিন্দূরের ত্রিপুন্ড্রকটিই তার পরিচয়।
মাথার ঘন বাবরি চুল হতে উগ্র কটু একটা কবিরাজী তেলের গন্ধ কবিরাজ মশাই সামনে এসে দাঁড়ালেই যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
গা পাক দিয়ে ওঠে, বমনোদ্রেক আনে।
কবিরাজ মশাই বলেন, তেলটি তাঁরই নিজস্ব আবিষ্কার। মহাশক্তি-দায়িনী বৃহৎ বনরাজী তৈল। মস্তিষ্ক শান্ত ও শীতল রাখার অব্যর্থ মহৌষধি।
উপরে এসে একটিমাত্র কথাই বলেন কবিরাজ মশাই, গরীব ব্রাহ্মণকে দয়া করুন।
ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা পরস্পরের মধ্যে মাসাতে একটিবার মাত্র ও ঐ একটি কথারই আদান-প্রদান ছাড়া আর কোন সম্পর্কই নেই।
ঘরভাড়া অবশ্য যে যার সকলেই চুকিয়ে দেন চাওয়া মাত্রই।
বলতে গেলে উপরের তলার অধিবাসীরা প্রতি মাসের দুই তারিখের ঐ সময়টির জন্য যেন পূর্ব হতে প্রস্তুতই হয়ে থাকেন।
৩. দিন পনের হলো
দিন পনের হলো কিরীটী এই বাড়ীতে এসেছে এবং ইতিমধ্যেই সকলের সঙ্গেই অল্পবিস্তর আলাপ-পরিচয়ও হয়ে গিয়েছে। সত্যশরণকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বাদবাকি পাঁচজন সহবোর্ডারদের মধ্যে একমাত্র ইনসিওরেন্সের দালাল রজতবাবুই যেন কিরীটীর দৃষ্টি একটু বেশি আকর্ষণ করেছেন।
কিরীটীর ঘরের একপাশে থাকেন রজতবাবু ও অন্যপাশে সত্যশরণ।
রজতবাবুর বয়স যাই হোক না কেন, ৩০-৩১-এর বেশি নয় বলেই মনে হয়। রোগাটে ছিপছিপে গড়ন। উজ্জল শ্যাম গাত্রবর্ণ। চোখেমুখে বুদ্ধির একটা অদ্ভুত ধারালো তীক্ষ্ণদীপ্তি। চোখে সরু সোনার ফ্রেমে শৌখিন চশমা। ভদ্রলোকের বেশভূষাতেও সর্বদা একটা শৌখিন পরিচ্ছন্ন রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। ইনসিওরেন্সের দালালীতে যে তাঁর অর্থাগমটা ভালই ভদ্রলোকের চাল-চলুন আচার-ব্যবহার ও রুচিবিলাস হতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। হাতও বেশ দরাজ।
কারণ এই বাড়ির সহ-বোর্ডারদের প্রায়ই এটা ওটা পাঁচরকম দামী খাবার এনে খাওয়ান ও নিজেও খান এবং মধ্যে মধ্যে সিনেমা-থিয়েটারেও নিয়ে যান।
ভ্রাম্যমাণ দালাল, সেইজন্য মধ্যে মধ্যে দুচার-পাঁচদিনের জন্য এবং কখনোকখনো দশদিনের জন্য কলকাতার বাইরে বাইরে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়।
উপরের তলার অধিবাসীদের মধ্যে একমাত্র রজতবাবুরই নীচে কবিরাজ মশাইয়ের বহিঃ ও অন্দরমহলে যে যাতায়াত আছে, প্রথম দুচারদিনেই কিরীটীর সেটা নজর এড়ায়নি। এবং রজতবাবুর নীচের তলার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে উপরতলার : বোর্ডার সিনেমার গেটকীপার জীবনবাবুর দুচারটে অম্লমধুর রসালো মন্তব্য যে কিরীটীর সদাসতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়িয়ে গিয়েছে তাও নয়। কিরীটী লক্ষ্য করেছিল নীচের তলাকার অধিবাসীদের মধ্যে কবিরাজ মশাইয়ের ছেলে ও মেয়ে অনিলশেখর ও অমলা উভয়ের সঙ্গেই রজত বাবুর কিঞ্চিৎ বেশ যেন আলাপ-পরিচয় আছে। কেবলমাত্র অবগুণ্ঠনের অন্তরালবর্তিনী, নিঃশব্দচারিণী কবিরাজের গৃহিণীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে কিনা সেটা জানবার সুযোগ হয়নি কিরীটীর। কবিরাজ-গৃহিণীকে তো কখনোও বাইরে বের হতে দেখা যেত না, কারণ শোনা যায় কবিরাজ মশায়ই নাকি সেটা পছন্দ করেন না। তাঁকে নিজেকেও বড় একটা বাইরে বের হতে দেখা যায় না। বেশীর ভাগ সময় সকাল সাতটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ও দ্বিপ্রহর দুটো থেকে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত ও সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে রাত্রি এগারটা প্রত্যহই এবং কোন কোন রাত্রে বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কবিরাজ মশাই বাইরের ঘরেই থাকেন। এবং তিনি যে আছেন সেটা মধ্যে মধ্যে একটিমাত্র তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত শব্দে জানা যেতঃ মাগো করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী, সবই তোর ইচ্ছা মা